অশোক দত্ত : চরম ইঞ্জিন সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রতিদিন প্রয়োজনের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ লোকোমোটিভও সরবরাহ করা যাচ্ছে না। যে ইঞ্জিনগুলো সচল রয়েছে, সেগুলোরও বেশিরভাগে রয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি। এর ফলে প্রতিদিন শিডিউল ভেঙে পড়ছে, ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে যাত্রীসেবা এবং স্থবির হয়ে পড়ছে পণ্য পরিবহন।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে অন্তত ১১৬টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন হয়, কিন্তু এর বিপরীতে চালানো যাচ্ছে মাত্র ৭৫ থেকে ৮০টি। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০টির মতো ইঞ্জিনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথে সংকট আরও প্রকট। এই অঞ্চলে প্রতিদিন ১১৬টি ইঞ্জিনের চাহিদা থাকলেও সচল রয়েছে মাত্র ৭০-৭৫টি। শুধু গত ছয় মাসেই পূর্বাঞ্চলে বিকল হয়েছে ১২২টি ইঞ্জিন, যার মধ্যে গত ডিসেম্বরেই বিকল হয়েছে ৩৮টি।
লোকোমোটিভ সংকট কাটাতে ২০২১ সালে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে প্রায় ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০টি আধুনিক ইঞ্জিন আমদানি করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু এরই মধ্যে ১২টি ইঞ্জিন অচল হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাব ও দক্ষ প্রকৌশলী না থাকার কারণে সেগুলো এখন ডিজেল শপে পড়ে আছে। নতুন কেনা ইঞ্জিনগুলো রেলের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চরম পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদেশি সহায়তায় ইঞ্জিন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করে স্থানীয় ওয়ার্কশপেই মেরামতের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে জানান, দ্রুত ২১টি ইঞ্জিন মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি মিটারগেজ এবং পাঁচটি ব্রডগেজ ইঞ্জিন রয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সংগ্রহে জটিলতার কারণে আমরা সমস্যায় পড়েছি। তবে এর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন দ্রুত অর্থ ছাড় হলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই লোকোমোটিভগুলো মেরামত করে রেল বহরে যুক্ত করা সম্ভব হবে।
বর্তমানে রেলওয়ের বহরে মোট ২৯৭টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে মিটারগেজ ১৬৭টি ও ব্রডগেজ ১৩০টি। তবে এর অর্ধেকেরও বেশি ইঞ্জিন আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে। রেলওয়ের হিসাবে, মাত্র ১৪৭টি ইঞ্জিন এখনো অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য, বাকিগুলো কার্যত মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে ৫০টির বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর, ১৬টির বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর এবং ৮৪টির বয়স ৪০ বছরের বেশি। সব মিলিয়ে মোট লোকোমোটিভের ৫১ শতাংশই অচল বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবই এই সংকটের মূল কারণ। মাস্টার প্ল্যান থাকলেও সময়মতো ইঞ্জিন কেনা হয়নি, দক্ষ জনবল নিয়োগ হয়নি। শুধু নতুন ইঞ্জিন আনার উদ্যোগ নিলেই চলবে না, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও টেকসই কৌশল গ্রহণ না করলে রেল আরও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
রেলওয়ের তালিকায় প্রায় ৩০ হাজার ধরনের যন্ত্রাংশ থাকলেও এর অনেকগুলোই বর্তমানে স্টকশূন্য। ফলে বিকল ইঞ্জিন মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ বলছে, নিজস্ব ওয়ার্কশপে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মেরামতের চেষ্টা চলছে এবং দক্ষ কর্মীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে বাস্তবে যন্ত্রাংশের অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংকট মোকাবিলায় রেলপথ মন্ত্রণালয় নতুন করে ৩০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিনকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিব রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস)। এছাড়া সদস্য হিসেবে রয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বুয়েটের একজন অধ্যাপক। এই কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে, যেখানে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা, জ্বালানি দক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তি, যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা ও বাংলাদেশের পরিবেশে ব্যবহার উপযোগিতা যাচাই করা হবে।
ইঞ্জিন সংকটে শুধু যাত্রীসেবা নয়, পণ্য পরিবহনেও বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দরে ১১২৩টি কন্টেইনার অপেক্ষায় পড়ে আছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ইয়ার্ডে লোড অবস্থায় রয়েছে ১২২টি কন্টেইনার এবং তেলবাহী তিনটি রেক। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনেও পড়ে আছে একটি তেলবাহী রেক।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের রংপুর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রিয়াজ শহীদ শোভন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে করে কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল ও অকটেন আনা হয়। কিন্তু ইঞ্জিন না থাকায় সময়মতো জ্বালানি পৌঁছায় না। এতে পেট্রল পাম্প মালিকরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। আবার অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে তেল সংগ্রহ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নতুন ইঞ্জিন কেনাই সমস্যার সমাধান নয়। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশের মজুত, দক্ষ প্রকৌশলী নিয়োগ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এ সংকট কাটানো সম্ভব নয়। অন্যথায় রেলওয়ে বারবার একই সমস্যায় পড়বে, আর যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি দীর্ঘায়িত হবে।

Discussion about this post