মনিরুল হক : নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন যেন নতুন উচ্চতা ছুঁইছে। বাজারে গেলেই ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠছে। তবু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে। সরকারি এই তথ্যের প্রতিফলন নেই বাজারে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে, বাড়ছে ক্ষোভ।
ক্রেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম কয়েক মাস বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল। শাকসবজি, মাছ, ডিমের দাম আগের তুলনায় কমেছিল। কিন্তু গত দুই থেকে তিন মাসে পরিস্থিতি আবার উল্টো পথে হাঁটছে। এখন বাজারে ৭০ থেকে ৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া দুষ্কর। কয়েক ধরনের সবজির দাম নিয়মিত সেঞ্চুরি হাঁকাচ্ছে। ডিমের ডজন যেটি কিছুদিন আগে ১১০ থেকে ১২০ টাকা ছিল, তা এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর কারওয়ানবাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, পটোল, করলা, ঝিঙে, কাঁকরোল, ঢ্যাঁড়শসহ অধিকাংশ সবজির দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজির নিচে নামছে না। ফুলকপি ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়, শিমের দাম উঠেছে ১৬০ টাকায়। তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে শুধু কাঁচা পেঁপে, মুলা আর চিচিঙ্গা।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই বাজারের তালিকা ছোট করছেন। কারওয়ানবাজারে কেনাকাটা করতে আসা বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাসের বাজার একসঙ্গে করি। মাছ-মুরগি সংরক্ষণ করা গেলেও সবজি প্রতি সপ্তাহে কিনতে হয়। এখন সবজি কেনাই দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।’
এক দিনমজুরের অভিযোগ, ‘আগে এক কেজি ডাল কিনতাম, এখন আধা কেজি কিনতে হয়। বাজারে গেলে হিসাব মেলানোই কঠিন।’
অন্যদিকে বিবিএস প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ পয়েন্ট। খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যপণ্যে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা বাড়তে থাকলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। বিশেষ করে রমজান বা উৎসবের সময়ে চাহিদা বাড়লে দাম আরও বাড়তে বাধ্য।
সব মিলিয়ে আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো স্বস্তি আসেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাজারে প্রতিদিনই ক্রেতাদের পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে, অথচ পরিসংখ্যানের কাগজে দেখা যাচ্ছে ‘স্বস্তির ছবি’। বাস্তব আর পরিসংখ্যানের এই পার্থক্য দূর না হলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসবে না বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এখনই সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে ভোগান্তি বাড়বেই।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজির হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম কমছে না বিভিন্ন কারণে। দাম না কমার পেছনে হলো- সরকারের তদারকির দুর্বলতা আছে এবং শাস্তির পরিমাণগুলো কার্যকর হচ্ছে না ঠিকমতো। এটা একটা মেজর কারণ। এছাড়া সরকারের উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সময় দাম বাড়লে সরকার যদি বিকল্প কিছু উদ্যোগ নিতো, এবার সে ধরনের কিছু আমরা দেখছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এগুলোর কারণে একটু সমস্যা বাড়ছে এবং ব্যবসায়ীরা আসলে বিষয়গুলোকে কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছেন না।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বাজারে চাল ছাড়া অন্যান্য সবকিছুর দাম স্বস্তিদায়ক। অচিরেই মুদ্রাস্ফীতি কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
তবে এর পরের দুই মাসে কোনো পণ্যের দামই কমেনি। বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম উল্টো বেড়েছে। এর মধ্যে মসুর ডাল একটি। বর্তমানে ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৬০ টাকা, দুই মাস আগে যা ছিল ১৩০ টাকা। মোটা দানার ডাল ছিল ১০০ টাকা কেজি, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা দরে।

Discussion about this post