নুসরাত জাহান : রাত যতই দীর্ঘ হোক না কেন রাতের আঁধার ভেদ করে সূর্য গোটা পৃথিবীকে আলোকিত করে তোলে। শূন্য আকাশে সূর্যকে ঢাকার জন্য যতই মেঘ জমা হোক না কেন সূর্যের আলোকে কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা যায় না। বর্তমান সময়ে তরুণ সমাজ সূর্যের আলোর ন্যায় দীপ্তি ছড়াচ্ছে, কাটিয়ে উঠছে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচারের কালো অধ্যায় থেকে। তরুণ সমাজে জাগরণ হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশ ও নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজšে§র ক্ষোভ, স্বপ্ন আর সাহস ইতিহাসকে নতুন পথে ঠেলে দিচ্ছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত আন্দোলন শুরু হয়। মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ হলেও পুলিশের দমননীতি, ছাত্রদের ওপর হামলা এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার মতো পদক্ষেপ আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ পনেরো বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে নেপালে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের মাধ্যমে সংকট শুরু হয়। তরুণ প্রজš§ বিশেষ করে জেনারেশন জেড প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। পুলিশের গুলি, টিয়ার গ্যাস আর কঠোর দমননীতিতেও তারা পিছু হটেনি। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ সারাদেশে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ ও নেপালের আন্দোলন দুই দেশেই তরুণ সমাজের চেতনার শক্তি নতুন করে প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে দেখা যায়, কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও আন্দোলন রূপ নেয় সার্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিতে। শিক্ষার্থীদের একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা সাধারণ মানুষকে আবেগাপ্লুত করে তোলে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়ার বিকল্প ব্যবহার ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রচার আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দেয়। নেপালে সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাই আন্দোলনের জš§ দেয়। বর্তমান প্রজš§ যাদের জীবনের বড় অংশ ডিজিটাল যোগাযোগের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছে এটি ছিল স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। ১৯ জনের মৃত্যু আন্দোলনকে আরও বিস্ফোরক করে তোলে। আগুনে পুড়তে থাকে সরকারি ভবন, সংসদ ভবন পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজর পড়ে কাঠমান্ডুর দিকে। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র যখন তরুণদের বৈধ দাবি উপেক্ষা করে কিংবা দমন করে, তখনই আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত সরকার পতন পর্যন্ত গড়ায়।
দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা অন্যায়, অবিচার, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণদের জাগরণ হয়েছে। তরুণদের এ জাগরণের পেছনে কিছু কারণ কাজ করেছে। যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে অন্যায়ের প্রতিরোধ। বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন কিংবা নেপালের সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা দুটিই তরুণদের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। অভিব্যক্তির স্বাধীনতা সবার ন্যায্য অধিকার। তরুণ সমাজ নিজেদের কথা বলার সুযোগ চায়। যখন সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়, তখন তাদের প্রতিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। ডিজিটাল যুগের শক্তি সকলের জন্য এখন নিত্যপ্রয়োজনীয়। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর যুগে ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আন্দোলন সংগঠিত করতে এবং সচেতনতা ছড়াতে এটি প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে। দীর্ঘকালীন শাসনের ক্লান্তিও দায়ী। উভয় দেশেই দীর্ঘ সময় ধরে একই নেতৃত্ব ক্ষমতায় ছিল। একঘেয়েমি ও দুর্নীতির অভিযোগ তরুণদের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে।
তরুণ সমাজের জাগরণকে যদি রাষ্ট্রের শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে হয়, তবে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই বলা যায়, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির কথা। তরুণদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাদের মতামত ও নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। মুক্ত ও সুষ্ঠু অভিব্যক্তি নিশ্চিত করা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি। ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে তরুণদের দাবিকে দমন করা কোনো সমাধান নয়। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থানের দ্বার উš§ুক্ত করা প্রয়োজন। এতে হতাশা কমবে, ইতিবাচক শক্তি বাড়বে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তরুণ সমাজ চায় একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য রাষ্ট্রব্যবস্থা।
বাংলাদেশ হোক কিংবা নেপাল একটি সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবশ্যই যোগ্য সরকার থাকতে হবে। সরকারের সঙ্গে জনগণের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার সম্পর্ক থাকতে হবে। সরকারের গোড়া থেকে দুর্নীতিকে মুক্ত করতে হবে। একটি সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন করতে হবে এবং তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আসন্ন সরকারকে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে নিয়োজিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ও নেপালের ঘটনাবলি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তরুণ সমাজ আর কেবল দর্শক নয়, বরং তারা সক্রিয় ইতিহাস নির্মাতা। তাদের শক্তি অবহেলা করলে রাষ্ট্র টিকতে পারে না। তবে এটিও সত্য, আন্দোলন কেবল সরকার পতন ঘটানোর জন্য নয় বরং একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য হওয়া উচিত। তরুণদের শক্তি যদি গঠনমূলক পথে পরিচালিত করা গেলে বাংলাদেশ ও নেপাল উভয় দেশই অচিরেই নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে বলে আশা করা যায়।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post