আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : রাজশাহী মহানগরীতে যানজট নিরসন ও নগরীর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একের পর এক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন (রাসিক), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) যৌথভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে সরেজমিনে চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। ফ্লাইওভার, ওভারপাস ও রাস্তা নির্মাণের নামে হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও যানজট যেমন কমেনি, বরং বেড়েছে। আর কাজের মান এতটাই নিম্নমানের যে ছয় মাসের মধ্যেই রাস্তার কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে।
এদিকে এই সমন্বিত নগর অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ৩০টি ওয়ার্ডে উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। এরই অরেক রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তিন বছর মেয়াদি এ উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ গত ২০২৪ জুনে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও অধিকাংশ কাজ বাকিই রয়েছে। কিন্তু যেসব রাস্তার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর ওপরের অংশের পিচঢালা পাথর উঠে যাচ্ছে। নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে।
অভিযোগ আছে, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে উল্লিখিত দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আগে ২০-২৫ ভাগ পর্যন্ত কমিশন আদায় করতেন। এর বাইরে প্রকৌশলীরা নেন তিন থেকে পাঁচ পার্সেন্ট কমিশন। এতে কাজের মান আরও খারাপ হচ্ছে। তবে বিভাগীয় কমিশনার প্রশাসকের দায়িত্ব নেয়ার পরে এখন অনেকটাই পরিস্থিতি ভালো হয়েছে বলেও দাবি করেন অনেকেই। কিন্তু প্রকৌশলী দপ্তরের কমিশন থামেনি এখনও।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রকল্পগুলো ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে রাজশাহী নগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প এবং যানজট নিরসন প্রকল্পের আওতায়Ñ১. ভদ্রা ওভারপাস (১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা); ২. কোর্ট স্টেশন ওভারপাস (১১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা); ৩. শহীদ কামারুজ্জামান চত্বর ওভারপাস (২০৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা); ৪. বিলসিমলা সমন্বিত ওভারপাস (২৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা); ৫. এছাড়া আরও বেশ কিছু রাস্তা প্রশস্তকরণ ও নর্দমা নির্মাণের কাজও হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল যানজট নিরসন, সড়ক সংযোগ বাড়ানো ও নগরীর সৌন্দর্যবর্ধন।
স্থানীয়রা জানান, যেসব রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কার করা হয়েছে, সেই রাস্তায় অধিকাংশ ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে ‘বাড়িভাঙা’ পুরোনো ইট। আবার ওপরের অংশে যে পরিমাণ বিটুমিন ও পাথর দিয়ে কার্পেটিং করার কথা, সেখানেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ফলে ছয় মাস না যেতেই ওয়ার্ড পর্যায়ের ওইসব রাস্তার কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। সরেজমিনে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। আর এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি, ড্রেন, ফুটপাত ও রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কারের সময় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঠিকাদাররা ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। এলাকাবাসীর পক্ষে নগর কর্তৃপক্ষ ও রাসিকের প্রকৌশলীদেরকে ফোন করে বারবার অভিযোগও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বিপরীতে ঠিকাদাররা ইচ্ছামতো কাজ করে গেছেন দাপটের সঙ্গে। কারণ সব কাজেরই দেখভাল করেছেন স্থানীয় ‘তৎকালীন আওয়ামী লীগে’র নেতাকর্মীরা। ফলে তাদের দাপটে ঠিকাদাররা দায়সারা কাজ করে সরকারি অর্থ লোপাটের মহোৎসবে নেমেছিলেন।
নগরীর বিলসিমলার এক বাসিন্দা জানান, মাত্র মাস দুয়েক আগে রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটির নির্মাণকাজ শেষ করেছে ঠিকাদার। ওইসময় রাস্তায় যেসব খোয়া ফেলা হয়েছিল, তার অধিকাংশই ছিলো বাড়ি বা রাস্তার পুরোনো ইটের খোয়া। আবার এক ইঞ্চিও পাথর দেয়া হয়নি কার্পেটিংয়ের সময়। বিটুমিনের পরিমাণও ছিল নামে মাত্র। ফলে তিন মাসও গেল না রাস্তাটির। এরই মধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে। হয়তো আর মাস ছয়েকের মধ্যে আবার খানা-খন্দে ভরে যাবে।
তিনি জানান, রাস্তাটি নির্মাণের সময় রাসিকের প্রকৌশলীদের বারবার অভিযোগ করা হয়েছিল; কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা এসে উল্টো আরও টাকা-পয়সা খেয়ে চলে যায় মনে হয়েছে। তা না হলে এই কাজ এত নিম্নমানের হওয়ার কথা নয়।
একই অভিযোগ করেন নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার আরেক বাসিন্দা। তিনি জানান, এ এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটির সংস্কারকাজ শেষ করা হয়েছে। কিন্তু এখনই কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। কাজ তো ভালোভাবে করেনি বরং জনগণের অর্থ লুট করেছে।
নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার আরেক বাসিন্দা জানান, এই এলাকায় বর্ষায় জলাবদ্ধতা লেগে থাকে। যে ড্রেন নির্মাণ হয়েছে সেটি কোনো কাজেই আসছে না। আবার ড্রেন নির্মাণের সময় নিম্নমাণের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। লোহার রডগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন প্যাকেজের আওতায় মহিষবাথান ঈদগাহ থেকে হড়গ্রাম বাজার ও কারিতাস মোড় থেকে রাজপাড়া মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার গড়ে ৪ মিটার প্রশস্ত রাস্তাটি সংস্কার হয়। কিন্তু দুটি রাস্তারই এরই মধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি।
রাসিকের দেয়া তথ্যমতে, সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন তিনটি প্যাকেজে আটটি ওভারপাস বা ফ্লাইওভার এবং ১৯টি ছোট-বড় অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া চলমান রয়েছে, ৮৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর হড়গ্রাম নতুনপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ে ও ওভারপাস নির্মাণকাজ, ১১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকাব্যয়ে কোর্ট স্টেশন রেলওয়ে ক্রসিংয়ে ৫২১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস, ২০৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে শহিদ কামারুজ্জামান চত্বর লেভেল ক্রসিংয়ে ৮৯৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস নির্মাণ, ১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ভদ্রা লেভেল ক্রসিংয়ে ৫২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস নির্মাণ, ২৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বন্ধ গেট এবং নতুন বিলসিমলা লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত ১ হাজার ২৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ সমন্বিত ওভারপাস নির্মাণকাজ। এরই মধ্যে প্রকল্পগুলোর অনেকখানি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে এসব কাজেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
রাসিক সূত্রমতে, একই প্রকল্পের আওতায় ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর রাজশাহী-নওগাঁ প্রধান সড়ক থেকে মোহনপুর-রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নর্দমা নির্মাণ, ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারি মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নয়ন এবং ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সড়ক ও নর্দমাগুলোর উন্নয়ন।
রাসিক সূত্র আরো জানায়, নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনে অযান্ত্রিক যানবাহন লেনসহ চারলেন সড়ক নির্মাণ করা রয়েছে ১৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার, কার্পেটিং সড়ক নির্মাণ ৩৬৮টি; কার্পেটিং সড়ক পুনর্নির্মাণ ২৫৮টি, কার্পেটিং সড়ক প্রশস্তকরণ ৫৩টি, সিমেন্ট কনক্রিট সড়ক নির্মাণ এক হাজার ৮০৭টি, ফুটপাত নির্মাণ ৪১ দশমিক ৯২ কিলোমিটার এবং গোরস্তান ও জলাশয়ের পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা রয়েছে ৬২ দশমিক সাত কিলোমিটার। জলাশয়গুলোয় সৌন্দর্যবর্ধনমূলক কাঠামো নির্মাণ ১৯টি। গণশৌচাগার নির্মাণ ৩০টি, পার্ক নির্মাণ চারটি, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার নির্মাণ, আটটি ফুটওভার ব্রিজ, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ৫০টি, কাঁচাবাজার চারটিসহ জলাশয় খনন ও সড়ক আলোকায়নসহ ৬৯টি ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার কথা রয়েছে। এসব কাজের অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এসব কাজেও ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। ফলে এরই মধ্যে রাস্তার ধারে ফুটপাতের টাইলসগুলো উঠে যাচ্ছে। ফুটপাতের সøাব হারিয়ে গেছে। জনসাধারণের চলাচলও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জলাশয়গুলোয় সৌন্দর্যবর্ধন করতে গিয়ে ছোট করে ফেলা হয়েছে পুকুরগুলো। আর পকেটে ভরেছে ঠিকাদার ও প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
রাসিকের একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের প্রকৌশলীরা অন্তত তিন থেকে পাঁচ পার্সেন্ট কমিশন আদায় করেন। সরকারি প্রকল্পে অলিখিত দুই ভাগ কমিশন আদায় করেন প্রকৌশলীরা। সেখানে রাসিকের প্রকৌশলীরা আদায় করেন তিন ভাগ। এতে কাজের মাণ আরও খারাপ হচ্ছে। এর বাইরে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আদায় করতেন ২৫-২৫ ভাগ। সবমিলিয়ে রাসিকের উন্নয়ন কাজে অন্তত ২৫ ভাগ টাকা হতো টেবিলে টেবিলে ভাগবাটোয়ারা। তবে এখন অনেকটা কমে গেছে। তবে এখনও বেপরোয়া প্রকৌশলীরা। তারা কমিশন ছাড়া কোনো বিল ছাড় করেন না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ঠিকাদার।
তবে বাস্তবতা হলো যানজট আগের মতোই রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আরও বেড়েছে। যেসব রাস্তার সংস্কার বা কার্পেটিং করা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগের ওপরের অংশ মাত্র ছয় মাসেই উঠে যাচ্ছে। ফুটপাতের টাইলস ভেঙে পড়েছে, ড্রেনের ঢাকনা উধাও। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোনো ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে এবং বিটুমিনের পরিমাণ ছিলো নামমাত্র।
উন্নয়নের নামে নিম্নমাণের কাজ ও অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী রাসিকের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহম্মদ আল মইন বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এসব নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারব না।
রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘কোনো কাজে অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিম্নমানের কাজ আর সহ্য করা হবে না।’ পরে তিনি জানান, আজকে মিটিংয়ে ব্যস্ত, তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার জন্য বলেন।
অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহীতে উন্নয়ন প্রকল্প মানেই কমিশন। কমিশন না দিলে কোনো কাজ পাওয়া যায় না। ফলে কাজের মান বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

Discussion about this post