গত এক যুগে ছয় ব্যবসায়ী পরিবার ও কয়েকজন সাবেক আমলা এবং ভুঁইফোঁড় কয়েকজন রাজনৈতিক বাটপাড়ের হাতে পড়ে বেসরকারি খাতের এক ডজন ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে। এই ঘৃণ্য কাজে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা কেউ জেলে, কেউ ফেরারি, কেউ প্রবাসে, কেউ পরপারে। এই কাজে সহায়তা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ব্যাংকের লাখো কোটি টাকা লুটপাটে পথে বসেছেন পুঁজিবাজারের ২০ লাখ বিনিয়োগকারী ও ৫০ লাখ আমানতকারী। কয়েকজন ব্যাংক চেয়ারম্যান, ডামি চেয়ারম্যান ও গোটা বিশেক এমডি কেবল চাকরি হারানোর ভয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সহায়তা করেন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ব্যাংক ডাচ্-বাংলা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ নিয়ে শেয়ার বিজ-এর তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব
শেখ শাফায়াত হোসেন : ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন আহমেদের হাত দিয়েই এটি জনপ্রিয়তা পায়। তার পরিবারের হাতে ব্যাংকটি গড়ে ওঠে। আবার তার পরিবারের হাত দিয়েই ব্যাংকটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাবিবারিক ভবন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হাতে গছিয়ে দিয়ে নিজ পবিবারের সুবিধা হলেও বিপদে পড়বে ব্যাংকটি। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
মতিঝিলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক যে ভবনটি তাদের প্রধান কার্যালয়ের জন্য কিনবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেটার বিক্রেতা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পরিবার। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, চেয়ারম্যান পরিবারের টাকার প্রয়োজন মেটাতে উচ্চমূল্যে ভবন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটি। এখানে ব্যাংকের স্বার্থ নয়, কেবল চেয়াম্যান পরিবারের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকছে বলে এ বিক্রির সিদ্ধান্ত বিতর্কিত ও অবৈধ।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, কেনাবেচার সিদ্ধান্ত যখন একই ব্যক্তির হাতে থাকে, তখন সেখানে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ অসম্ভব। এ কারণে সব দেশের কোম্পানি আইনে প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থ জড়িত থাকলে তা অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ আইনেও এ ধরনের কেনাকাটা অবৈধ হলেও লাজলজ্জার মাথা খেয়ে পর্ষদ এ ধরনের অনিয়ম নিয়মিত করে এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও এটাকে অনুমোদন দেয়। এতে ঝুঁকিতে পড়ে ব্যাংক খাত ও বিনিয়োগকারীরা।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাহাবুদ্দিন আহমেদ এখন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে না থাকলেও কার্যত তিনিই ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এর ুআগে ছেলে সায়েম আহমেদ ছিলেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান। বর্তমানে মেয়ে সাদিয়া রাইন আহমেদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৩ সালের জুনে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোনো ব্যাংক তার পরিচালকের মালিকানাধীন ভবন কিনতে পারে না। এমনকি পরিচালকের ভবনে ভাড়া থাকাও উচিত নয়। এতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের পরিচালকরাই কেবল মালিক নন। প্রকৃত মালিক হলেন সাধারণ আমানতকারীরা। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সাহাবুদ্দিন আহমেদ এখনও আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। এখন চাচ্ছেন বড় অঙ্কের অর্থ ব্যাংকটি থেকে বের করে নিতে। এ কারণে হয়তো ব্যাংকটিকে চাপ দিয়ে ভবন কিনতে রাজি করিয়েছেন।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বাজারমূল্যের এত বেশি দাম দিয়ে এই ভবন কেনার অনুমোদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেবে না। দরকার হলে আমরা বিষয়টি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নজরে নিয়ে আসব। কোনো কর্মকর্তা ওই অনুমোদনের ফাইলে স্বাক্ষর করলে তার চাকরি রাখব না।’
দেশের টেক্সটাইল খাতের পুরোনো ব্যবসায়ী পরিবার থেকে এসেছেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তার দাদার প্রতিষ্ঠিত ‘তামিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস’ উত্তরাধিকার সূত্রে পান তিনি। কিন্তু ব্যবসায়িক ব্যর্থতা, বিদেশি তহবিল ব্যবস্থাপনায় জটিলতা ও উচ্চসুদের চাপে পড়ে সাহাবুদ্দিন একসময় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এর পরই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা পায় সাহাবুদ্দিন আহমেদের পরিবার ও নেদারল্যান্ডসের উন্নয়ন অর্থায়ন কোম্পানি এফএমওর যৌথ উদ্যোগে।
বর্তমানে সাহাবুদ্দিন আহমেদ এএ হোল্ডিংসের অধীনে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে পরিবারিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের বিভিন্ন পদে আছেন। তবে এই বনেদি পরিবারটি প্রচার এড়িয়ে চলে। এ কারণে তাদের সম্পর্কে অনেক তথ্যই মানুষের অজানা।
জানা গেছে, সাহাবুদ্দিন আহমেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অন্যান্য ব্যাংক থেকে এসব ঋণ নেয়া হয়েছে। ঋণগুলো এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। ব্যাংক এশিয়ার মামলার পর এমন তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে।
গত ২৪ আগস্ট ব্যাংক এশিয়ায় ১২৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মামলায় ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৫-এর বিচারক মুজাহিদুর রহমান সাহাবুদ্দিন আহমেদ ও তার ছেলে সায়েম আহমেদের প্রায় ২০ কোটি শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। ওই শেয়ারের বাজারমূল্য ৮১৯ কোটি টাকা। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোট শেয়ারের যা প্রায় ২৩ শতাংশ।
ব্যাংক এশিয়া সূত্র জানিয়েছে, ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে ব্যাংক এশিয়া থেকে ঋণ নেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং তার ছেলে সায়েম আহমেদ। এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির কাছে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক ছিল না। দুই দফা এই ঋণ পুনঃতপশিল করেও তারা টাকা পরিশোধ করেননি। এ কারণে ব্যাংক এশিয়ার ঋণ আদায়ের সুবিধার্থে ডাচ্-বাংলার শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে।
এর ঠিক এক দিন পর অর্থাৎ গত ২৬ আগস্ট ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পর্ষদ এক হাজার ১৬ কোটি টাকা খরচ করে একটি বাণিজ্যিক ভবন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ধারণা, মাত্র ২৫০ কোটি টাকা থেকে ৩০০ কোটি টাকায় মতিঝিলের মতো প্রাইম লোকেশনেও এ ধরনের ভবন নির্মাণ করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, সাড়ে ২১ তলা ওই ভবনটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী ও সাবেক চেয়ারম্যন সায়েম আহমেদের মা আছমা আহমেদের মালিকানাধীন।
অর্থাৎ, বর্তমান চেয়ারম্যান সাদিয়া রাইন আহমেদের মায়ের নামে থাকা ভবনটাই কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটির পর্ষদ। ঢাকার ৪৭ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ওই ভবনটিই ভাড়া নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক তাদের প্রধান কার্যালয় চালিয়ে আসছে। মোট ২ লাখ ৭ হাজার ৩৪০ বর্গফুট আয়তনের এ ভবনের প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার টাকা।
নির্মাণ খাত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে সর্বোচ্চ ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা খরচ হতে পারে। সেই হিসাবে ভবনটির বাজারমূল্য অনেক কম হবে।
তাছাড়া শেয়ার বিজ বাজার বিশ্লেষণ করে দেখতে পায়, দেশের আরও বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক তাদের প্রধান কার্যালয়ের জন্য নিজস্ব ভবন নির্মাণ করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই খরচ অনেক কম হয়েছে।
অথচ ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এই উচ্চ মূল্যের লেনদেন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এ নিয়ে কথা বলতে চেয়ারম্যান সাদিয়া রাইন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে শেয়ার বিজ। তিনি দেশের বাইরে থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকটির বিদেশি পরিচালক আদা তাং ইউয়েন হা-কে ইমেইলের মাধ্যমে বিষয়টি অবগত করে বক্তব্য চাওয়া হলে তিনিও কোনো জবাব দেননি।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নিজেরা ভবন নির্মাণ করার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। এ ধরনের ভবন তৈরি করতে ১০ বছর লেগে যায়। এসব বিবেচনা করে আমরা ভবনটি কিনতে রাজি হয়েছি। তাছাড়া আমরা দাম কিছুটা কমিয়েছিও।’
এর আগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এ ভবনটি ভাড়া নিয়ে প্রধান কার্যালয় পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে আপত্তি জানায়। তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির এক বৈঠকে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন, ভাড়া না দিয়ে নিজস্ব ভবন কেনা বা নির্মাণ করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে। তবে এই পাঁচ বছরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক নিজস্ব ভবন নির্মানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
জানা গেছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রতি মাসে প্রায় দুই কোটি ৪৭ লাখ টাকা ভাড়া দিচ্ছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে ১৪০ কোটি টাকার বেশি ভাড়া বাবদ চেয়ারম্যানের পরিবারকে পরিশোধ করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে শেয়ার বিজ। তবে তিনি সম্প্রতি অস্ত্রোপচারজনিত চিকিৎসা নেয়ায় বেশিরভাগ সময় অফিস করেন না বলে জানা যায়। এ কারণে মতিঝিলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও এমডির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, এই ভবন কেনার সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব তথ্য যাচাই করে অনুমোদন দিলে তবেই এটি কিনতে পারবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সাহাবুদ্দিন আহমেদকে আগে ভালো লোক মনে হতো। এখন তার কার্যক্রম দেখে তেমনটা আর মনে হয় না। পর্ষদকে হয়তো তিনি ভবনটি কেনার জন্য চাপ দিয়েছেন। এতদিন ভাড়া খেয়েছেন। এখন টাকার দরকার, বেশি দামে বিক্রি করবেন। এর জন্য হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংককেও রাজি করাবেন। সহজ কথায় বললে বলতে হবে, হয়তো ঘুষও অফার করবেন।’
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির মুনাফা নেমে এসেছে ৪৭৩ কোটি টাকায়, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৪১ শতাংশ কম। খেলাপি ঋণের হারও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। আগের বছর এই হার ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ।
ভাড়া, কর, বিমা ও বিদ্যুৎ বাবদ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, এর বড় অংশই যাচ্ছে ভবন ভাড়ার খাতে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল এটিএম বুথে বিনিয়োগ বাড়ানো। তবে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটির এটিএম বুথের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ২০২০ সালে ব্যাংকটির ৪ হাজার ৮৬২টি এটিএম বুথ ছিল। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪ হাজার ১৫১-তে।

Discussion about this post