নিজস্ব প্রতিবেদক : নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে সরকার নিয়মিত তালিকা প্রকাশ করলেও বাস্তব বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নির্ধারিত দামে নিত্যপণ্যের তালিকা প্রকাশ করে, কিন্তু রাজধানীসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সেই দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই। ফলে প্রতিদিন সাধারণ ক্রেতাদের পকেটে চাপ বাড়ছে এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টিসিবির তালিকায় দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, অথচ বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনপ্রতি নির্ধারিত হয়েছিল ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। দেশি মসুর ডালের দাম তালিকায় ছিল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, বাস্তবে তা পাওয়া যাচ্ছে ১৮০ টাকায়। করলা নির্ধারিত ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। ঢ্যাঁড়শ ও পটোল নির্ধারিত ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা, বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ টাকায়। বরবটির দাম তালিকায় ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা, বাস্তবে মিলছে ১২০ টাকায়।
এদিকে শসার নির্ধারিত দাম ছিল ৮০ টাকা, কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ টাকায়। ঝিঙার দাম তালিকায় ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা, বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। ধুন্দলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা, অথচ বাজারে মিলছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। চিচিঙ্গার দাম তালিকায় ছিল ৮০ টাকা, অথচ বাজারে তা ১২০ টাকা। নতুন শিমের দাম নির্ধারিত ছিল ২২০ থেকে ২৪০ টাকা, কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ টাকায়। কাঁচামরিচের দাম তালিকায় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা থাকলেও বাজারে তা ২০০ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে না। পেঁপের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, অথচ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। আলুর নির্ধারিত দাম ২৫ টাকা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়।
বাজারে প্রতিদিনের এই দামের অমিল ভোক্তাদের জন্য মারাত্মক সমস্যা তৈরি করছে। সাধারণ পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সবজি ও নিত্যপণ্য কিনতেই ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। টিসিবির তালিকায় সস্তা হিসেবে যেসব পণ্যকে ধরা হয়, বাস্তবে বাজারে সেগুলোর দামও তালিকার চেয়ে বেশি। ফলে তালিকা থাকা সত্ত্বেও তার সুফল ভোক্তারা পাচ্ছেন না।
মনিরা বেগম নামে রাজধানীর মিরপুরের এক গৃহিণী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদিন বাজারে এসে দেখি সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। সরকার-নির্ধারিত দামের তালিকা দেখি টিভি আর পত্রিকায়, কিন্তু বাজারে এসে সেই দামে কিছু পাওয়া যায় না। শুধু সবজি কিনলেই হাজার টাকার নোট ভাঙাতে হয়।
কাজীপাড়া কাঁচাবাজারের আরেক ক্রেতা মাইনুল ইসলাম বলেন, সরকার যদি তালিকা প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করে, তাহলে এর কোনো মানে নেই। বাজারে মনিটরিং না থাকলে ক্রেতারা প্রতিদিনই ঠকবে।
অন্যদিকে বিক্রেতারা দোষ চাপাচ্ছেন পাইকারি বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর। বিক্রেতাদের দাবি, পাইকারি বাজার থেকেই তারা বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হন। সরবরাহ ঘাটতি, মৌসুমি প্রভাব, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং কিছু ক্ষেত্রে মজুতদারির কারণে দামে অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে খুচরা বিক্রেতারা সরকারের নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে না পেরে বাস্তবতার ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করেন।
মিরপুর কাঁচা বাজারের বিক্রেতা জালাল উদ্দিন বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে যত দামে কিনে আনি, তার থেকে কম দামে তো বিক্রি করতে পারি না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে, সেই দামে মাল পাওয়া যায় না। আমাদেরও তো লাভ করতে হবে।
আরেকজন বিক্রেতা মানিক হোসেন জানান, বর্ষার কারণে অনেক সবজির উৎপাদন কমেছে। আবার পরিবহন খরচও বেড়েছে। এ কারণে দাম বাড়ছে। দোষ শুধু খুচরা বিক্রেতাদের নয়।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, শুধু তালিকা প্রকাশ করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। বাজারে যদি নজরদারি ও কার্যকর মনিটরিং না থাকে, তবে নির্ধারিত দাম কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যায়। পাইকারি বাজারে দামের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে খুচরা বাজারেও স্থিতিশীলতা আসবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে স্বচ্ছ সরবরাহ ব্যবস্থা, নিয়মিত মনিটরিং এবং ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিমূলক কাঠামোর আওতায় আনতে পারলেই এই অস্থিরতা কমানো সম্ভব।

Discussion about this post