নিজস্ব প্রতিবেদক : হাসিনা সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছেন আখতারুজ্জামান বাবুর দুই সন্তান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও আনিসুজ্জামান চৌধুরী। ভারত ও মালয়েশিয়াসহ পাঁচটি দেশে আখতারুজ্জামান বাবুর বড় ছেলে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ায় তার সম্পদ অর্জনের রেকর্ডপত্র উদ্ধার করেছে দুদকের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স। এর আগে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে সাইফুজ্জামানের ৫৮২টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। রাজনীতি বিশ্লেষকদের প্রশ্নÑতারা এত সম্পদের পাহাড় কীভাবে গড়ে তুললেন?
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে অর্জিত সম্পদ এবং অর্থপাচারে জড়িত দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী উৎপল পাল ও আব্দুল আজিজ রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তাদের দেয়া তথ্যে ২৩ বস্তা আলামত জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এসব বস্তায় বিদেশে সম্পদ অর্জনের নথি, বিল পরিশোধের তথ্য ও ভাড়া আদায়ের আলামত আছে বলে জানা গেছে। গতকাল রোববার ভোরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শিকলবাহা এলাকার সিকদার বাড়ি থেকে এসব আলামত জব্দ করা হয়। তবে দেশে–বিদেশে এত সম্পদ অর্জনের পরও তাদের পুরো পরিবার গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে পালিয়ে যায়। এ নিয়ে আল জাজিরায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। তার পর থেকে জাভেদ ও তার স্ত্রীসহ পরিবারের কারোরই কোনো হদিস মেলেনি।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মশিউর রহমান বলেন, ‘সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তাদের ৫ দিনের রিমান্ড চলছে। রিমান্ডে পাওয়া তথ্যে জানলাম যে অনেকগুলো ডকুমেন্টস গায়েব করা হয়েছে, যেগুলো রুকমিলা জামানের ড্রাইভার ইলিয়াসের বাসায় রাখা হয়েছিল। গত শুক্রবার আমরা সেখানে অভিযান চালাই। কিন্তু আমাদের অভিযানের তথ্য পেয়ে বস্তাগুলো সরিয়ে ফেলে। ওই দিন আমরা বাসার সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করি। ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমরা যাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে এই আলামতগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।’
তিনি বলেন, ‘পরে আমরা সাইফুজ্জামানের স্ত্রী ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রুকমীলা জামানের ড্রাইভার মো. ইলিয়াস তালুকদারের বাড়ি থেকে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ সংক্রান্ত ২৩ বস্তা রেকর্ডপত্র উদ্ধার করি। এসব রেকর্ডপত্র থেকে পাঁচ দেশে সম্পদ অর্জনের নতুন এ তথ্য পাওয়া যায়। কয়েকটি বস্তা খুলে দেখা গেছে, বিদেশে সম্পদ অর্জনের ক্রয়–সংক্রান্ত পেমেন্ট, বাড়ি ভাড়া আদায়ের তথ্য, বিভিন্ন বিল পরিশোধ, কোর্টের আদেশসংক্রান্ত ডকুমেন্টস রয়েছে। এখনও সবগুলো বস্তার আলামত পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি। কাজ চলছে।’
দুদকের জনসংযোগ (উপপরিচালক) কর্মকর্তা মো. আক্তারুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, উদ্ধারকৃত আলামত প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইতোপূর্বে প্রাপ্ত ৪টি দেশের (যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই ও সিঙ্গাপুর) ৫৮২টি সম্পদ ছাড়াও ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ায় সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে। এছাড়া দেশে–বিদেশে ক্রয়কৃত বাড়ির মালিকানা, ভাড়ার আয়, মেইনটেন্যান্স ব্যয়সহ বিভিন্ন তথ্য ও ডকুমেন্টস এবং সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দ্বারা বিদেশে মুদ্রা পাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণও এ ডকুমেন্টে রয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া উৎপল পাল আরামিট গ্রুপের এজিএম হলেও দীর্ঘদিন ধরে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশে সম্পদ তৈরি ও দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতেন। দুদকের হাতে আটক হওয়ার সময় তার কাছ থেকে দুটি ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব ডিভাইস থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
উৎপল পাল দেশ থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার মূল হোতা বা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করতেন। অন্যদিকে আব্দুল আজিজ, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেডের এজিএম হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তি কেনাবেচা, ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন।
এর আগে গত ২৪ জুলাই দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মশিউর রহমান বাদী হয়ে ভূমিমন্ত্রী জাবেদসহ ৩১ জনকে আসামি করে মামলাটি করেছিলেন। মামলায় জাবেদ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেনÑজাবেদের স্ত্রী ও ইউসিবিএল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রুকমিলা জামান (৪৬), ব্যাংকের পরিচালক আসিফুজ্জামান চৌধুরী (৪৬), জাবেদের বোন রোকসানা জামান চৌধুরী (৫৬) এবং ইউসিবিএল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বশির আহমেদ (৫৫)।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নামে খুলে দেয়া হয় পাঁচটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান– ভিশন ট্রেডিং, আলফা ট্রেডার্স, ক্ল্যাসিক ট্রেডিং, মডেল ট্রেডিং ও ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং। এরপর ইউসিবিএল ব্যাংকের চট্টগ্রাম বন্দর শাখায় এসব প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খুলে গম, ছোলা, হলুদ ও মটর আমদানির নামে ২৫ কোটি টাকার টাইম লোন অনুমোদন করানো হয়। ব্যাংকের নিজস্ব ‘ক্রেডিট কমিটি’র ১৭টি নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করে ২০২০ সালের ৮ মার্চ পরিচালনা পর্ষদ ওই ঋণ অনুমোদন দেয়। এরপর সেই টাকা ভাগ করে একই ব্যাংকে খোলা চারটি হিসাব নম্বরে স্থানান্তর করে পাচার করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়Ñব্যাংক পরিচালক, ঋণ আবেদনকারী এবং অনুমোদনকারী সবাই একে অপরের আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সমন্বিত চক্রান্তের মাধ্যমে এ লোন নেয়া ও টাকা পাচার করা সম্ভব হয়।
ইউসিবিএল ব্যাংকের ‘করপোরেট ব্যাংকিং ডিভিশন ও ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন’-এর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটি ওই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ১৭টি নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিল। নেতিবাচক প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ কোনো ধরনের যাচাই–বাছাই না করে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণের টাকাগুলো ‘নামসর্বস্ব’ চারটি প্রতিষ্ঠানÑআলফা ট্রেডার্স, ক্ল্যাসিক ট্রেডার্স, মডেল ট্রেডিং ও ইম্পেরিয়াল ট্রেডিংয়ের ব্যাংক হিসাবে পে অর্ডারের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়। পরে তা নগদে উত্তোলন করা হয়। টাকা স্থানান্তর করা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা আরামিট গ্রুপের কর্মচারী।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, এসব টাকা নগদে উত্তোলনের পর উত্তোলনকারী আরামিট গ্রুপের কর্মচারীরা পে অর্ডার, ভাউচারের মাধ্যমে ইউসিবিএল ব্যাংকের বহদ্দারহাট শাখায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের হিসাবে বিভিন্ন সময়ে জমা করেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, আসামিরা দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪০৯, ৪২০, ৪৭১ ও ১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ করেছেন।

Discussion about this post