রেজাউল করিম খোকন : স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন লক্ষ্যণীয় বিষয়। বারবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আলোচনায় এসেছে। সর্বশেষ স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কবল থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এ দেশের ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসন টিকিয়ে রাখতে গণবিরোধী ভূমিকা পালন না করে প্রকারন্তরে সহায়তা করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সবার প্রশংসা ও ভালোবাসা অর্জন করেছে নতুনভাবে। স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার পতন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা নাশকতা সৃষ্টির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে ইতিহাসে এক অনন্য অসাধারণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। যখন জনরোষের কবল থেকে রক্ষা পেতে দেশের অধিকাংশ থানা ছেড়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছিল তখন শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করে সাহসী ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। রাজনীতি ও পেশাদার সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনীর দুটি আলাদা জগত হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনীতিতে প্রভাব বা রাজনীতি নিয়ে রাজনীতিকদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগাযোগ কেন থাকবে, সমস্যাটা কোথায় রাজনীতির দুর্বলতা নাকি ব্যর্থতা, এসব প্রশ্ন উঠছে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ, পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও ব্যর্থতার কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়নি। ফলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আর সেটাই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করেছে অনেকবার। এই পরিস্থিতিকে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোও অস্বীকার করতে পারবে না।
বেশ কয়েক দফায় সামরিক শাসনসহ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা দৃশ্যমান হয়েছে বা প্রকাশ্যে এসেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এরপর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে ক্যূ পাল্টা ক্যু চলতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বর ক্ষমতার কেন্দ্র চলে আসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিপরীতে সামরিক বাহিনীর উত্থান প্রথম দেখা যায়। ৭ নভেম্বরই বাংলাদেশের রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার আগেই সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। সামরিক শাসন জারি রেখেই তিনি দেশ পরিচালনা করেন। ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে রাজনীতিতে নামেন তিনি। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে নিহত হন সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যের করা ব্যর্থ অভ্যুত্থানে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পরই ক্ষমতা দখল করেননি। তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। ঘটনার ১০ মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। ক্ষমতা দখলের কয়েক মাস আগে থেকেই দেশ শাসনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা রাখার বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরে আসছিলেন তিনি। নেপথ্যে নানা ঘটনা সৃষ্টির মাধ্যমে সামরিক শাসন জারির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন চতুর এরশাদ। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীর উর্দি পরা অবস্থায় রাজনৈতিক অভিলাষ পূর্ণ করতে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলে তার স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনকে দীর্ঘায়িত করছিলেন। কিন্তু নব্বই-এর গণ-আন্দোলনের মুখে তাকে গদি ছাড়তে করা হয়েছিল। নব্বইয়ে সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে উদারপন্থি, ডান, বাম-সব দলের আন্দোলন এক পর্যায়ে গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। জেনারেল এরশাদ তার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে কারফিউ দিয়ে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী আন্দোলন দমনে মাঠে কোনো ভূমিকা রাখেনি। সেনাবাহিনী সে সময় জেনারেল এরশাদের পক্ষ সমর্থন করেনি বা অবস্থান নেয়নি। সে সময়ের সেনাবাহিনীর সেই ভূমিকা নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা হয়েছিল। নব্বইয়ের পরে ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর ভূমিকা দৃশ্যমান হয়েছিল। যদিও তখন সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় বসেনি, বেসামরিক লোকেদের দিয়ে সরকার গঠন করা হয়েছিল।
সেনাবাহিনী যে কোনো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। পর্যবেক্ষণ বাস্তবতায় ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশের প্রায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো সেনাবাহিনীকেও নিজ দল আওয়ামী লীগের পক্ষে ভয়াবহরূপে ব্যবহার করেছেন। এক এগারোতেও মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং জনমানুষের নির্বাচনী মতামতকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। অবৈধভাবে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ২০০৮ সালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এমনকি ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রারম্ভিক পর্যায়ে সেনাবাহিনী পড়েছিল উভয় সংকটে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ফ্যাসিস্ট হাসিনাপন্থি ও ছাত্র-জনতার পক্ষে বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে ছাত্র-জনতার পক্ষের শক্তির। ৫ আগস্ট ২০২৪ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকায় পুরো জাতি ভয়ংকর-ভয়াবহ সংকটময় মুহূর্ত থেকে মুক্তি পেল। আবার প্রমাণিত হলো সেনাবাহিনী বাংলাদেশের পট-প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ। সহজেই অনুমান করা যায়, সেদিন এই ভূমিকা না নিলে মারাত্মক রক্ত সংঘাতের প্রাণ বিধ্বংসি গৃহযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকিতে নিক্ষিপ্ত হতো। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হতো না যদি সেনাবাহিনীর মেজর জিয়া ‘উই রিভোল্ড’ বলে অস্ত্র হাতে তুলে না নিতেন। এমনকি ৭ নভেম্বরে ১৯৭৫-এ সিপাই-জনতার জাতীয় বিপ্লব ও সংহতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সেদিন যথার্থ না হলে আজকের বাংলাদেশ দেশবাসী দেখতে পেত না। ১৯৯০-এ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সেদিন যেদিন তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নূরউদ্দীন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের ওপরে একটি গুলিও চালাবে না।’ শাসকের অন্যায় অবিচারে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা সবসময়ই সাহসী ভূমিকায় আন্দোলন-সংগ্রাম করে বটে, জেল-জুলুম মিথ্যা মামলায় হয়রানি গুম-খুন-আয়নাঘরের ভয়ংকর পরিণতি বরণ করে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জুলুম-নির্যাতনকারী সরকারের পদত্যাগ পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। অর্থাৎ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জাতীয় জীবনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবজনক ভূমিকা খুবই স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ আগস্ট। ছাত্র জনতার আন্দোলনে উত্তাল দেশ, রাজধানী। একদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা। অন্যদিকে অবস্থান করছে আওয়ামী প্রশাসনের পুলিশ বাহিনী ও সশস্ত্র গ্রুপ। যে কোনো সময় গুলি ছুটে আসবে ছাত্র জনতার বুকে। ঠিক এমন সময় দেখা যায় সেনা সদস্যদের। সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখে উল্লাসে ফেটে পরে উপস্থিত জনতা। জনতার পাশে দাঁড়িয়ে ফাঁকা গুলি ছোঁড়েন সেনা সদস্যরা। সরে যায় প্রতিপক্ষ। জনতা এগিয়ে যায় রাজপথে। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেয়া, মিলকারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলো রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ব্যক্তি ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে তা দেশের সব বিবেকবান উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে। ঘটা করে এসবের কোনো প্রচার নেই। সেনাবাহিনী প্রচারে অভ্যস্থও নয়। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের পুলিশি কাজও করছে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা ওঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বসভার সদস্যদের প্রতিক্রিয়ায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জনগণের ওপর দমন-পীড়ন রোধ করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা একটি ইতিবাচক ঘটনা। জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে দেশ গঠনেও নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকার একটি নতুন দৃশ্যায়ন ঘটলো এবার।
এবারের পট পরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কী রকমের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি হয়েছে, কত সড়ক-মহাসড়কে অবরোধ হয়েছে, কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে সরকারি সংস্থা অথবা অফিস সংক্রান্ত জটিলতা হয়েছে অনেকেরই এ সংক্রান্ত ধারণা নেই। দ্রুতগতিতে কোনো প্রচার বা হাঁকডাক ছাড়াই সেনা সদস্যরা সেগুলো ফয়সালা করেছেন। টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে অপ্রীতিকর ঘটনার সমাধানও করেছেন। বড়দিন, পূজা, মাহফিল, উরস, রাসমেলা, নবান্ন উৎসবসহ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনে কী দায়িত্ব তারা পালন করেছেন গণমাধ্যমের কাছেও সেসব তথ্য নেই। কাজগুলো সচরাচর পুলিশের। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর দুর্গতির কারণে সেনাবাহিনীকে চালাতে হয়েছে এসব কর্মধারা। তা বিনা বাধায় বা নিমিসে হয়নি। কাজগুলো করতে গিয়ে সেনা সদস্যদের যন্ত্রণা ও আহতের হিসাব বেশ দীর্ঘ। গণ-আন্দোলনের পূর্বাপর সময়ে দেশের পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি অনেকের অজানা। এ সময় বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের হাত থেকে স্থানীয় নিরীহ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর কেবল বিশেষ যৌথ অভিযান নয়, জীবনবাজি রেখে কাজ করতে হয়েছে। এখনও করছে। শত শত কেএনএফ সদস্য ও তাদের সহায়তাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। স্বয়ংক্রিয়সহ নানা ধরনের বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ, সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এসব কাজ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহতও হয়েছেন। পার্বত্যাঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধানের কাজও করেছে।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসাররা যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে কোনো হাঁকডাক বা শোডাউন ছাড়াই। যার সুবিধা পেয়ে আসছে গোটা দেশ। বাহিনীটির এ অবদান ইতিহাস হয়ে থাকবে। কাজ ও অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিপালন বিচেনায় সেনাবাহিনী তার ‘দেশপ্রেমিক’ বিশেষণের সম্মান অক্ষরে অক্ষরে রাখতে পেরেছে। তা বিশ্বব্যাপী আলোচিত-প্রশংসিত। একটি রক্তাক্ত পরিস্থিতি কেবল মোকাবিলাই করেনি সাহসী মধ্যস্ততায় চমৎকার ফয়সালা রচনায় সেনাপ্রধান, তার কলিগ ও বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা ছিল অনেকের কাছে অকল্পনীয়। সেনাবাহিনীর এমন ভূমিকাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ চিহ্নিত করছেন ম্যাজিক নামে। সেনাবাহিনীর ৫ আগস্ট ও পূর্বাপর ভূমিকা দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। সেনাবাহিনী সেদিন কেবল রাজনৈতিক ফয়সালায় ভূমিকা রাখেনি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়ও দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে। দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। গুরুতর আহত কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশও পাঠিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর এখন সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর অভিযাত্রার আকাঙ্ক্ষার কথা ওঠে এসেছে বাহিনীটির প্রধানের সাম্প্র্রতিক কিছু বক্তব্যে। দেশি বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমে জেনারেল ওয়াকার উজ জামান কথার মধ্যে কোনো মেদ না রেখে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে সোজাসাপ্টা বলেছেন- সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করতে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারে পাশে থাকার কথাও বলেছেন। এই সময়ে ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। অশান্তির পর দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিশ্চিত এক সঙ্গে কাজ করলে ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ধরনের আত্মবিশ্বাস ও অঙ্গীকারের পর সামনে একটি সুন্দর-সুষ্ঠু অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদ না জেগে পারে না। এর উল্টোটা হলেই বাধে বিপত্তি। দম্ভ, অহঙ্কার, স্বেচ্ছাচার মাত্রাগতভাবে বাড়বাড়ন্ত হলে কী পরিণতি ভুগতে হয় তার দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে অনেক রয়েছে।
চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনের প্রায় শেষ মুহূর্তে ৩ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকে ‘জনগণের ওপর গুলি নয়’-বার্তাটি গোপন থাকেনি। অতি উৎসাহী দলবাজ, গোঁয়ার গোবিন্দ পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠের অবস্থা জানার বোধও যেন হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার কর্মকর্তাদের বৈঠক নিয়ে নিজেদের সেখানে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনের পাশে দাঁড়াবে। ‘তবে বিভিন্ন সময় যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় ছিল, তাদের বিরুদ্ধেও অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে এ ধরনের অভিযোগ জোড়ালোভাবে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণ ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা বিরোধী দল ও মত দমনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে ব্যবহার করেছে। দলটির শাসনে গুম-খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের বিষয়টিও সুযোগ সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করি। এভাবেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং জনতার কাছে একান্ত ভরসাস্থল হিসেবে উঠে আসে। কেবল আগস্ট নয়। এর আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীকে দেখা যায় শক্তিশালী একটি অবস্থানে। অভ্যুত্থানের সময় অথবা অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রথম সারিতে কাজ করে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। একটি দেশ তৈরি হবার সময় থেকে আদ্যবধি যে প্রতিষ্ঠানটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এসেছে সেই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে বিভিন্ন সময় সৃষ্টি করা হয়েছে নানা প্রশ্ন। এ বিষয়ে একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, যখনই দেশ রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী এই সেনাবাহিনীকে ঘিরে প্রশ্ন ওঠানো হয় ঠিক তখনই দেশকে ঘিরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গভীর এক ষড়যন্ত্র। যার মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে সেনাবাহিনীকে যে কোনো উপায়ে বিতর্কিত করে তোলা। বাংলাদেশের সাম্প্র্রতিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ঘিরে প্রশ্ন তোলার সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। সেনাবাহিনীর এই অবস্থান আর দৃঢ়তার পেছনে রয়েছে বর্তমান সেনাপ্রধান, সেনাবাহিনী সদস্য আর সাবেক সেনাসদস্যদের সমন্বিত এবং সুশৃঙ্খল অবস্থান। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বেশ কিছু ঝুঁকির মাঝ দিয়ে গেছে। বিশেষ করে একটি অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। গত প্রায় এক বছরে দেশের ভঙ্গুর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিকের পথে হাঁটছে। যদিও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে এখনও সময় প্রয়োজন। তবে সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তিত— যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। অন্যদিকে বিদেশি শক্তির সামনেও দেশের সেনাবাহিনী নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান দেখিয়েছে। করিডোর ইস্যুসহ বেশ কিছু ইস্যুতে দেশের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টাও অনেকটাই খর্ব করতে সক্ষম হয়েছে সেনাবাহিনী। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান। দেশকে এগিয়ে নিতে সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান সবসময়েই স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের বিষয়ে সজাগ। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর চেতনার মূল উৎস হলো সংবিধানের নির্দেশনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির অসীম আত্মত্যাগ থেকে পাওয়া শিক্ষা। এই চেতনায় বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। রাজনৈতিক ক্ষমতা হোক অথবা প্রভাব। দেশের সামগ্রিক স্থিরতা রক্ষায় দেশের অন্যতম খুঁটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যার দক্ষ এবং সুযোগ্য নেতৃত্ব ওয়াকার উজ জামানের হাতে। যিনি সেই নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে আসছেন সততার সঙ্গে। তবে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান শক্তি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সাবেক ও বর্তমান সেনা সদস্যদের জন্য রাষ্ট্রেরও রয়েছে দায়িত্ব। রাষ্ট্র যেন সেই দায়িত্ব ভুলে না যায়। বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের লুটপাট, দুর্নীতি আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জনগণ যখন নিষ্পেষিত ও প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগেছে তখনও ন্যক্কারজনকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেই অন্যায়-অনিয়ম-অব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পক্ষপাতমূলকভাবে ব্যবহার করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার। লক্ষণীয় যে, ২০১৮ সালের নিশিরাতের ভোট শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ বলেছিলেন, ‘বিগত ৪৭ বছরে এ রকম শান্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আমি দেখিনি।’ অথচ অবিসংবাদিতভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি গৌরবের সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান। যেখানে সর্বোচ্চ চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করা হয়। সংস্থার নীতিবাক্য হলো ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের’। এছাড়া দেশের ও দেশের বাইরে সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনবদ্য। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাংলাদেশের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দেশের ক্রান্তিলগ্নে জনগণের পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা। এর উদাহরণ আমরা অনেক দেখেছি। বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রায় প্রতি বছর বন্যাদুর্গত এলাকায়, সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায়, নিমতলী, মাইলস্টোন স্কুলসহ বিভিন্ন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অর্থাৎ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা সমুজ্জ্বল। এর বাইরে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা যাচাইয়ে নানারকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের মেধা ও মননের পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে জনমানুষের যা কল্যাণকর, মঙ্গলজনক সেখানে প্রয়োজনমতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিন বাহিনীর সদস্যরা। তবে মর্যাদা ও সম্মান দেখানো আমাদের দায়িত্ব হলেও সেনাপ্রধান তথা সেনাবাহিনীরও সতর্ক থাকা দরকার। রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো ধরনের বিতর্কের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া যাবে না পেশাদার এই বাহিনীকে। আর পেশাদারিত্ব বজায় রাখার জন্য কখন কাদের সঙ্গে বৈঠক করা যেতে পারে আর কার সঙ্গে বৈঠক অযৌক্তিক সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। গুজব-বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সেনাবাহিনীকে তার নিজস্ব শৃঙ্খলা বজায় রেখে দেশের মানুষের প্রতি ন্যায্য কমিটমেন্ট অব্যাহত রাখতে হবে। এ দায়িত্ব সেনাবাহিনীর সব সদস্যের। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ, জরুরি অবস্থা বা মার্শাল ’ল জারি বাংলাদেশের জন্য খুবই অপ্রাসঙ্গিক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী যথাযথ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post