নিজস্ব প্রতিবেদক : শিল্প প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশকে দ্রুত একটি টেকসই, বিনিয়োগ-প্রস্তুত জ্বালানি কাঠামোর দিকে অগ্রসর হওয়া জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
ব্যবসায়ী নেতা, নীতিনির্ধারক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে গতকাল বুধবার রাজধানীর দ্য ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত এক নীতিগত সংলাপে এ সতর্ক করেন।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা, উচ্চ উৎপাদন ব্যয়, নীতিগত অসঙ্গতি ও বিনিয়োগ ঝুঁকি আগামী বছরগুলোয় দেশের শিল্প ও অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সক্ষমকরণ: একটি টেকসই বিদ্যুৎ খাত বিনিয়োগ জলবায়ু বিকাশ’ শীর্ষক এ সংলাপে বক্তারা বলেন, ‘অবকাঠামোতে বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও শক্তি খাত কাঠামোগত দ্বন্দ্ব, জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা, গ্যাস ঘাটতি ও প্রকল্প বিলম্বের কারণে গভীর সংকটে রয়েছে। ‘কেবল আরও মেগাওয়াট নয়, দরকার বিনিয়োগযোগ্য মেগাওয়াট’।
ইএমএ পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও ইপিভি ঠাকুরগাঁও লিমিটেডের পরিচালক আবু চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের এখন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ালেই হবে না; এই বিদ্যুৎ হতে হবে টেকসই, প্রতিযোগিতামূলক এবং বিনিয়োগযোগ্য।’
তার মতে, দেশের জ্বালানি খাত কেবল ক্ষমতা ঘাটতির দিকে নয়, বরং আরও গভীর কাঠামোগত দুর্বলতার দিকে এগোচ্ছেÑ যার প্রভাব ২০৩১ সালের পর স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি সতর্ক করেন, বর্তমান গতিপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে উৎপাদন অবকাঠামো সক্রিয় থাকলেও এর অর্থনৈতিক কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, ফলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ‘স্থাপিত ক্ষমতার পরিসংখ্যান আশাব্যঞ্জক হলেও গ্যাসের ঘাটতি, জ্বালানির বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রকল্প অনুমোদনের বিলম্ব বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।’
তার মতে, শুল্ক অস্থিরতা, নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তা এবং ভর্তুকিনির্ভর জ্বালানি আমদানি বেসরকারি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ দুটিকেই নিরুৎসাহিত করছে। তিনি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি পুনর্বিবেচনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির দ্রুত সংযুক্তি এবং বেসরকারি জ্বালানি বিনিয়োগকারীদের জন্য নিশ্চিত রিটার্ন গ্যারান্টি প্রবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
২০ বছরের পুরোনো নীতিতে চলছে বিদ্যুৎ খাত: বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘দেশের বিদ্যুৎ খাত এখনও ১৯৯৬ সালের পুরোনো নীতির ওপর নির্ভরশীল, যেখানে প্রতিবেশী ভারতের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির আধুনিক নীতি গ্রহণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘অত্যধিক আশাবাদী চাহিদা পূর্বাভাসের কারণে উৎপাদনমুখী সম্প্র্রসারণ ঘটলেও সঞ্চালন ও বিতরণে সময়মতো বিনিয়োগ না হওয়ায় কার্যক্ষমতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।’
একক-ক্রেতা মডেলের আর্থিক দুর্বলতার কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি কেন্দ্রীয় ক্রেতা আর্থিকভাবে স্থিতিশীল না হয়, তাহলে পুরো বিদ্যুৎ শৃঙ্খলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
জালাল আহমেদ শিল্প-কারখানার ছাদে সৌরশক্তি স্থাপনার সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, দেশের মাত্র ৪ হাজার গার্মেন্ট কারখানা যদি ৫ থেকে ১০ মেগাওয়াট করে সৌরশক্তি উৎপাদন করে, তবে একাই ২০ থেকে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
বৈচিত্র্যময় জ্বালানি মিশ্রণের ওপর জোর: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন বলেন, ‘বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংকটের কারণে বহু বছর ধরে শিল্প প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’
তিনি অতীত প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বলেন, ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি জ্বালানি খাতের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে।’
তিনি সৌর, বায়ু, বর্জ্য থেকে শক্তি, সীমিত পারমাণবিক এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎসহ বৈচিত্র্যময় জ্বালানি মিশ্রণ গঠনের ওপর জোর দেন। পাশাপাশি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় সম্পদ অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি নীতিকে রাজনীতিমুক্ত রাখা, এক-স্টপ পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং স্থগিত শিল্প অঞ্চলগুলো সক্রিয় করার আহ্বান জানান।
জামায়াতের অভিযোগ ও পরিকল্পনা: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শুরা সদস্য মোবারক হোসেন অভিযোগ করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতের উন্নতির নামে খাতটিকে বিপর্যস্ত করেছে। তিনি দাবি করেন, জামায়াত ক্ষমতায় এলে তারা নিজেদের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে জ্বালানি খাতে উন্নয়ন ঘটাবে।
সৌরশক্তির জন্য ভূমিনীতি সংস্কারের আহ্বান: এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, বাংলাদেশের অন্তত ৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন নতুন নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিশেষ করে সৌরশক্তি থেকে আসা উচিত। কিন্তু জমির অভাব এ খাতে বড় বাধা। এই সমস্যা মোকাবিলায় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে সৌর অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পরামর্শ দেন তিনি।
অর্থনীতি-শিল্প সংযোগ জোরদার করার তাগিদ: এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে সম্পদ সৃষ্টি ও ব্যবসায়িক সাফল্যের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে সে কাঠামো এখনো দুর্বল। এক শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য শক্তিশালী জ্বালানি খাত অপরিহার্য, আর সেটির ভিত্তি হতে হবে স্বচ্ছতা, পূর্বনির্ধারিত নীতি ও বেসরকারি উদ্যোগের কার্যকর অংশগ্রহণ।’
সংক্ষেপে, সংলাপে বক্তারা বলেন, জ্বালানি খাতে অবিলম্বে কাঠামোগত সংস্কার, নীতি আধুনিকায়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্র্রসারণ, সঠিক সঞ্চালন ও বিতরণ পরিকল্পনা এবং বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি; নইলে আগামী এক দশকের মধ্যেই দেশ একটি বড় বিদ্যুৎ সংকটের সম্মুখীন হতে পারে।
প্রিন্ট করুন








Discussion about this post