ব্রিজ কেমি লিমিটেড সিরামিক শিল্পের অনন্য জনপ্রিয় এক প্রতিষ্ঠান। গত ১৭ বছর যাবত এই খাতের উন্নয়নে নানামুখী সেবা দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। ব্রিজ কেমি লিমিটেডের গ্রাহকের তালিকায় রয়েছে সিরামিক ও টেক্সটাইল খাতের পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। সিরামিক শিল্পের লাইটহাউসখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল করিমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেয়ার বিজের মীর আনিস
শেয়ার বিজ: সিরামিক খাতে নতুন কেউ প্লান্ট করলে বা প্লান্ট এক্সপান্ড করলে ব্রিজকেমির কাছে আসে সহযোগিতা নিতে। আপনি কী কী ধরনের সহযোগিতা করেন?
নাজমুল করিম: সিরামিক খাতে কোনো উদ্যোক্তা প্ল্রান্ট স্থাপন করতে চাইলে বা কেউ তার চলমান প্ল্রান্ট সম্প্রসারণ করতে চাইলে আমরা নিম্নোক্ত সহযোগিতা করে থাকি।
(ক) প্রয়োজনীয় সকল ধরনের কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং প্লান্ট স্থাপনে অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে সংযোগ করে দেয়া।
(খ) প্লান্ট সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় এবং উপযোগী মেশিনারিজ,অ্যাকসেসরিজ ইত্যাদি নির্বাচন ও ক্রয়ে সহায়তা করা।
(গ) প্লান্ট/মেশিনারিজ স্থাপন-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় কারিগরি সার্ভিস প্রদান।
(ঘ) আমরা সিরামিক শিল্পের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল, কেমিক্যাল, প্রিন্টিং আইটেম ইত্যাদি সরবরাহ করি। ওই প্রয়োজনীয় আইটেম ব্রিজ কেমী নিজস্ব দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের মাধ্যমে প্ল্রান্টে টেস্ট এবং পরবর্তী সময়ে সরবরাহ করা হয়। তদুপরি ব্রিজ কেমি সব ধরনের আন্তর্জাতিক মানের পণ্য মজুত ও সরবরাহ করে সিরামিক কারখানায় নিয়মিত সহায়তা প্রদান করে।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পের এখনও কৈশোর পার হয়নি। এখনও দেশের ১০ শতাংশ মানুষ টাইলস ব্যবহার শুরু করেনি। টেবলওয়্যার, সেনিটারি ওয়্যার এবং এসব পণ্যের বিলাস দ্রব্য এখনও অনেক দূরে। নির্মাণ খাতের লোকজন বলছেন, আগামী ৫০ বছর এ খাতটি টানা প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। আপনি কী মনে করেন?
নাজমুল করিম: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত বর্ধনশীল। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন অপরিহার্য। নির্মাণ খাতের সংশ্লিষ্ট অংশীজন মন্তব্য করেছেন, ‘আগামী ৫০ বছর এ খাত টানা প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।’ এ মন্তব্যের সঙ্গে আমি অনেকাংশেই একমত।
যদিও আমাদের দেশে ১০ শতাংশ মানুষ টাইলস ব্যবহার শুরু করেনি, তথাপি টাইলস সাব-সেক্টরে বিনিয়োগ সিরামিকের অন্যান্য সাব-সেক্টরÑটেবিলওয়্যার ও স্যানিটারি ওয়্যারের চেয়ে বেশি (৬৬ শতাংশ)। একই সঙ্গে এই সাব-সেক্টরের উৎপাদনের সিংহভাগ (৯৭ শতাংশ) দেশীয় বাজার আত্তীকরণ করে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ টাইলসের বাজার বিশাল, সেইসঙ্গে সম্ভাবনাময়ও বটে।
শেয়ার বিজ: সেনেটারি সিরামিকের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিখ্যাত ব্যান্ড রোকা, গ্যারোটিড, কোটো, ইনাক্স, গ্রহি, অ্যাক্সর, কোহলারসহ সব দামি ব্র্যান্ডই এদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই রকম ব্যান্ডের কাছাকাছি কোনো পণ্য কি এদেশি উদ্যোক্তারা তৈরি করছে? না করলে পারছে না কেন?
নাজমুল করিম: এ প্রশ্নের উত্তরের শুরুতে স্যানিটারি সাব-সেক্টরের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ও এর বাজারের অবস্থা জানা প্রয়োজন।
বিসিএমইএ প্রদত্ত তথ্যের আলোকে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট ১৮টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বছরে ১৯০ মিলিয়ন স্যানিটারি পণ্য উৎপাদন করে। ওই উৎপাদনের ৯০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার আত্তীকরণ করে এবং মাত্র ১০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ বেসিক স্যানিটেশনের আওতায় রয়েছে। অন্যদিকে দ্রুত অর্থনৈতিক বর্ধনশীল দেশের জনগোষ্ঠীর গড় আয়ের ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে।
এক্ষেত্রে স্যানিটারি ওয়্যারের দেশের বাজার এখনও বিশাল ও অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। তবে ক্রয়ক্ষমতার বিষয় বিবেচনায় নিলে আন্তর্জাতিক মানের স্যানিটারি ওয়্যারের চাহিদা দেশীয় বাজারে অতি ক্ষুদ্র।
আপনি জানেন, বর্তমানে মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয় এবং রপ্তানিকৃত ওয়্যার অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। আমাদের দেশের প্রথম সারির স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদনকারী, যেমন আকিজ বশির গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, চারু প্রভৃতি ইউরোপিয়ান টেকনোলজি ব্যবহার করে বিশ্বমানের স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদন করছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় চেষ্টারত।
শেয়ার বিজ: সিরামিক শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী? উদ্যোক্তারা কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন?
নাজমুল করিম: সিরামিক শিল্পের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো হলোÑ
১. অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ ও গ্যাসের চাপের ওঠানামা।
২. বন্দর ব্যবস্থাপনায় জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা এবং সঠিক সময়ে কাঁচামাল গুদামজাত করায় অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, যা উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে পড়ে।
৩. সিরামিক শিল্পের প্রায় শতভাগ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধি।
৪. সাম্প্রতিক বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সিরামিক পণ্যের বাজার সংকোচন।
৫. প্রদত্ত গ্যাসের চাপ ওঠানামার কারণে পণ্যের ডিফেক্টিভ হার বেড়ে গেছে। সেইসঙ্গে এটি পণ্যের গুণগত মানের ওপর প্রভাব ফেলছে।
৬. ব্যাংক অর্থায়নের কড়াকড়ির কারণে চলতি মূলধনের সংকট।
৭. পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি, পূর্ববর্তী সরকারে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সার্বিকভাবে সব শিল্পের মতো সিরামিক শিল্পে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যায়।
বৈশ্বিক ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোক্তারা Production process-G automation, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, জ্উ-তে অধিকতর মনোযোগী হওয়া, গুণগত মান বজায় রেখে তুলনামূলক কম দামের কাঁচামালের ব্যবহার বৃদ্ধি প্রভৃতির দিকে জোর দিয়েছেন।
শেয়ার বিজ: সিরামিক খাতে বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার ধরা কি অসম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তাহলে কীভাবে?
নাজমুল করিম: সিরামিক খাতের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মিটিয়েও বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার ধরা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকার ও উদ্যোক্তা উভয়ের ভূমিকা রয়েছে।
সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো এ খাতের অত্যাবশ্যকীয় গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং বন্দর ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও চলতি মূলধনের ঋণের ক্ষেত্রে সহনীয় সুদ ধার্য করা। বিদেশি বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা। সিরামিক খাতের এপেক্স সংগঠন ‘Bangladesh Ceramic Manufacturers and Exporters Association (BCMEA)’-কে বৈশ্বিক বাজার ধরার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলো চীন ও ভারত। কিন্তু এসব দেশ বেশিরভাগ প্রচলিত সিরামিক পণ্য উৎপাদন করে, যেখানে বৈচিত্র্যের ঘাটতি রয়েছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও শ্রমের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উন্নত দেশগুলো সিরামিক পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও পণ্যের মান নিশ্চিতে ভূমিকা পালন করবেন।
শেয়ার বিজ: সিরামিক শিল্পের বিশ্ববাজারে আরএমজি সেকটরের মতো অবস্থান তৈরি করতে হলে শুরুটা কীভাবে করতে হবে?
নাজমুল করিম: বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পের ইতিহাস বহু পুরোনো। বস্তুত এক্ষেত্রে জগে সেক্টরের মতো বহুমাত্রায় উৎপাদন সম্ভব নয়। কারণ পর্যাপ্ত জায়গা, গ্যাস, দক্ষ জনবল প্রভৃতি দরকার এবং এটির ব্যবহারও সীমিত। শুধু আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন এবং বৈশ্বিক বাজারে ব্যাপকভাবে বিপণনের মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা সম্ভব। অন্যদিকে দেশীয় বাজারের একশ ভাগ বিপণনের মাধ্যমে আমদানিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়েও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমানো যেতে পারে।
শেয়ার বিজ: এ খাতের বিকাশে সবচেয়ে জরুরি…
নাজমুল করিম: এ খাতের বিকাশে সবচেয়ে জরুরি হলো-
১. নিরবচ্ছিন্ন ও পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
২. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বন্দর ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন।
৩. পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ।
৪. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
৫. আমদানিকৃত কম শুল্কের পণ্যের ট্যারিফ সমন্বয়করণ।
৬. রপ্তানি বাজারের ভিন্নতা চালু করা । (Introducing variations to the export market)
শেয়ার বিজ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নাজমুল করিম: আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post