শেখ শাফায়াত হোসেন : একটা সময় উন্নত জীবনের আশায় সরকারি চাকরির প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়তেন চাকরিপ্রার্থীরা। এখন করপোরেট সেক্টরের চাকরির সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে এতটাই যে, চাকরিপ্রার্থীরা এখন সরকারি চাকরির থেকেও করপোরেট চাকরিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। চাকরিপ্রার্থী ও করপোরেট সেক্টর লিডারদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা যায়।
শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের করপোরেট জব উপযোগী করে গড়ে তুলতে সে ধরনের পাঠদান প্রক্রিয়া (কারিকুলাম) গ্রহণ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই প্রথম এই লক্ষ্য নিয়ে পাঠদান প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনে। পরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সেই পথ অনুসরণ করতে শুরু করে।
ফলে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এই কাতারে রয়েছে ব্যাংক, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, টেলিকমিউনিকেশন, গার্মেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল, আইটি, ফিনটেক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানই এখন শিক্ষিত তরুণদের প্রধান চাকরি-গন্তব্য।
এ বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের অনেকগুলো জরিপে ইতোমধ্যে উঠে এসেছে বিষয়টি। আইবিএ-এমবিএ শেষ করে শিক্ষার্থীরা এখন আমাদের মতো ভালো ব্যাংকগুলোয় চাকরি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সময়ের সঙ্গে নিজেদের পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনছে, যাতে শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, কম্পিউটার সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা সায়েন্স, মার্কেটিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যান্স, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট-এসব বিষয়ের চাহিদা এখন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের ‘ফিউচার অব জবস রিপোর্ট, ২০২৫’-এ বলা হয়, আগামী ২০২৫-২০৩০ সময়কালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৭ কোটি নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। সেইসঙ্গে চাকরির প্রায় ৩৯ শতাংশ স্কিল-দক্ষতার পরিবর্তন আশা করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ব্যবহারিক দক্ষতার ওপর। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট, লাইভ প্রজেক্ট, কেস স্টাডি, ওয়ার্কশপ এবং সেমিনারের আয়োজন বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব কাজের পরিবেশ সম্পর্কে আগেই ধারণা পাচ্ছে। যেমন, একজন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী শুধু ক্লাসে ‘মার্কেট সেগমেন্টেশন’ বা ‘কনজ্যুমার বিহেভিয়ার’ শিখলেই চলবে না; তাকে বাস্তবে মার্কেট রিসার্চ, কনজ্যুমার সার্ভে, ডিজিটাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করতে হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এখন অনেক বেশি বাস্তবমুখী হয়ে উঠছে।
করপোরেট জব টার্গেট করার ক্ষেত্রে শুধু একাডেমিক ফলাফল নয়, সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডিবেট ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, রোবোটিক্স ক্লাব, মডেল ইউনাইটেড নেশনস (মুন), ভলান্টিয়ার সংগঠন, স্টার্টআপ প্ল্যাটফর্ম-এসবের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা করপোরেট জগতে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। নেতৃত্ব, দায়িত্ব পালনের মানসিকতা, দলগত কাজে অভ্যস্ততা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে।
বিভিন্ন গবেষণা যেমন হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, ফোর্বস ম্যাগাজিন এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে ‘টেকনিক্যাল স্কিল’-এর পাশাপাশি ‘সফট স্কিল’-এও পারদর্শী হতে হবে। যোগাযোগ দক্ষতা, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যাডাপ্টিবিলিটি না থাকলে ভালো ডিগ্রিধারী হয়েও করপোরেট জগতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সংযোগ থাকে। গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, টেসলা ও আইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থীদের বাছাই করে নেয়। বাংলাদেশেও এখন সেই ধারা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের সরাসরি চাকরির সুযোগ দিচ্ছে। ফলে করপোরেট জব টার্গেট করে পড়াশোনা করার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।
কেবল নিজের বিভাগ নয়, বরং গুগল ড্রাইভ, এক্সেল, প্রেজেন্টেশন, ডেটা অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন-এসব শেখা উচিত, কারণ গ্লোবাল রিপোর্ট বলছে, ২০২৫-৩০-এর মধ্যে এআই, বিগ ডেটা, নেটওয়ার্কস, সাইবার সিকিউরিটি-সংক্রান্ত দক্ষতার চাহিদা সবচেয়ে দ্রুত বাড়বে।
এক অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ করে এআই ও গ্রিন জবে ‘ডিগ্রি-বেসড হিয়ারিং’ কমে যাচ্ছে এবং ‘স্কিল-বেসড হিয়ারিং’ বাড়ছে। অর্থাৎ, এখন কাজ দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে, শুধু সনদ নয়।
একজন শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি গ্রাফিক ডিজাইন, প্রোগ্রামিং, কনটেন্ট রাইটিং, ভিডিও এডিটিং, ডেটা অ্যানালাইসিস বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো স্কিল শেখে, তাহলে তার চাকরির সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আপওয়ার্ক, ফাইবার, ফ্রিলান্সারের মতো আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতের চাকরির বাজার হবে ‘স্কিল-ভিত্তিক’। অর্থাৎ সার্টিফিকেটের চেয়ে দক্ষতাই এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প, যেমন মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল-এসব বাস্তবায়নের ফলে করপোরেট সেক্টরেও নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। কনস্ট্রাকশন, লজিস্টিকস, ট্রান্সপোর্টেশন, আমদানি-রপ্তানি, হোটেল-ট্যুরিজম ও আইটি সেক্টরে দক্ষ পেশাজীবীর চাহিদা বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষ মানবসম্পদ না থাকলে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ব্রিটিশ কাউন্সিল ও টোফেল বা আইইএলটিএসের বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা থাকলে বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারে প্রবেশের সুযোগ অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার বলেন, করপোরেট পরিবেশে কাজ করার জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা গুরুত্ব পাচ্ছে। তাছাড়া অফিশিয়াল যোগাযোগ, ইমেইল, রিপোর্টিং, প্রেজেন্টেশনÑসবকিছুতেই ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উচিত পড়াশোনার পাশাপাশি ইংরেজিতে কথা বলা, লেখা ও উপস্থাপনার অনুশীলন করা।
নারীদের ক্ষেত্রে করপোরেট দুনিয়ায় প্রবেশ একসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং; কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। বাংলাদেশের বহু নারী করপোরেট নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ব্যাংকিং, মিডিয়া, গার্মেন্টস, টেলিকম ও প্রযুক্তি খাতে নারীদের উপস্থিতি দিন দিন বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসন পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিবিএ ও এমবিএ শিক্ষার্থীদের কাছে চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ বিকাশ। ৫৩টি বহুজাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেরা পছন্দের নিয়োগদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয় এই প্রতিষ্ঠানটি।
ওই জরিপে লক্ষ করা গেছে, বিজনেস স্কুলের শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বা এফএমসিজি এবং আর্থিক প্রযুক্তি (ফিনটেক) বা এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে রেখেছেন। এর পরই রয়েছে ব্যাংকিং এবং টেলিকম খাত।
প্রতিষ্ঠানের সুনাম, দক্ষতা অর্জনের সুযোগ, বেতন কাঠামো, কাজের স্বাধীনতা ও কর্মক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ এবং প্রতিষ্ঠানের সেরা মেধাবী ও দক্ষ কর্মীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির আগ্রহ তৈরি করে।
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম শেয়ার বিজকে বলেন, বিকাশ এর মত ফিনটেক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। প্রতিনিয়ত উদ্ভাবন আর প্রযুক্তিকে সঙ্গী করে কোটি মানুষকে সেবা দেয়ার সুযোগ নব্য গ্রাজুয়েটদের এখানে কাজে আগ্রহী করে তোলে। আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাকে দক্ষ পেশাজীবি হতেও সহায়তা করে। ফলে সম্প্রসারিত হতে থাকা ফিনটেক খাতে, বিকাশ এর মত প্রতিষ্ঠান চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য অন্যতম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post