নিজস্ব প্রতিবেদক : চিকিৎসাব্যয়ে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় আস্থার অভাব, সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়া ও অনুন্নত সেবা ব্যবস্থাপনার কারণে এমনটি হচ্ছে। এর বাইরে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র এক শতাংশেরও কম বরাদ্দ অন্যতম কারণ। তাই স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি উন্নত চিকিৎসার জন্য বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ আরও বাড়ানো দরকার। চিকিৎসায় আরও উন্নত যন্ত্র ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে।
গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে আস্থা বৃদ্ধি; মান নিয়ন্ত্রণে কৌশলগত কাঠামো নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অডিটোরিয়ামে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী।
প্রধান অতিথি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় বেশ অর্জন রয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে কাক্সিক্ষত মান নিশ্চিতের করা যায়নি, এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত দেশগুলোর মতো নয়, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বাংলাদেশের পক্ষে ইউনিভার্সেল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তবে আমাদের প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের ওপর বেশি হারে জোর দিতে হবে। এ খাতের ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ডিজিটাল হেলথ কেয়ার কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায় স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব। সেই চিকিৎসা শিক্ষাক্রম আধুনিকায়নের পাশাপাশি এ খাতে গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশে নিশ্চিত করার ওপর তিনি জোরারোপ করেন।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দেশে মানসম্মত ও রোগীবান্ধব সেবা নিশ্চিতে এখনও কাঠামোগত ঘাটতি রয়ে গেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র এক শতাংশ বরাদ্দ, সরকারি-বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা মানের অসমতা, মানবসম্পদের ঘাটতি, অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ফার্মেসির সম্প্রসারণ, ভুল ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট, ভুয়া ওষুধ ও তদারকি দুর্বলতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি বিদ্যমান আইনে বাস্তবায়নে উদাসীনতা জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও আস্থাকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবহার না থাকার কারণে মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৭৪ শতাংশ ব্যক্তিকে নিজস্ব ব্যয়ে বহন করতে হয়, যা নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিকভাবে বড় ঝুঁকিতে পড়ে থাকেন। এমন অবস্থায় দেশে একটি টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সামগ্রিকভাবে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব জোরদার, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি, নার্সিং, ল্যাব সায়েন্স ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল উন্নয়ন, সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রয়োগ অপরিহার্য।
গ্রিন লাইফ সেন্টার চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, যেহেতু দেশের বেশিরভাগ লোকই সরকারি খাতের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে, তাই সরকারি হাসপাতালগুলোতে সর্বোত্তম মান উন্নয়ন ও নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। এ খাতের সব স্তরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, দেশীয় স্বাস্থ্য খাতের বাজার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ খাতের আস্থা ফিরাতে সরকারি-বেসরকারি খাত ও জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে, পাশাপাশি এ খাতে পিপিপি মডেলের ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। তিনি জানান, আমাদের চিকিৎসা শিক্ষায় অংশ নেয়া বিদেশি শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেন, যদিও কাক্সিক্ষত চিকিৎসা প্রাপ্তি অসংখ্য বাংলাদেশি অন্যান্য দেশে সেবা নিয়ে থাকেন, তাই বিষয়টি নিয়ে সচেতনভাবে চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, স্বাস্থ্য খাতের আস্থা বাড়াতে সেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে রোগীদের যোগাযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিষয়ক নেতিবাচক সংবাদ পরিহার এবং সর্বোপরি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার উপর জোরারোপ করা প্রয়োজন।
ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার কারণে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে এবং ১৬০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, তার মানে হলো আমাদের উৎপাদিত ওষুধের ওপর আস্থা রয়েছে, তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ সালে হলেও গত ১৪ বছরেও তা যুগোপযোগী করা এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের কোনো সমন্বিত নীতিমালা নেই।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় গ্রিন লাইফ সেন্টারের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের ডিন অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার মিত্র, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাফিউন নাহিন শিমুল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মো. জাকির হোসেন, আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ-এর ম্যানেজার (পলিসি অ্যাডভোকেসি) ডা. মুশারাত জাহান, ইউনিসেফ বাংলাদেশের হেলথ সিস্টেমস স্পেশালিস্ট ডা. ফিদা মেহরান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), বাংলাদেশ-এর ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (রোগী নিরাপত্তা ও রক্ত নিরাপত্তা) ডা. মুরাদ সুলতান অংশগ্রহণ করেন।
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post