এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকৃত মালিক কে!

বিশেষ প্রতিনিধি: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ উদ্বোধন করা হয়েছে সম্প্রতি। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীন এ প্রকল্পে জমি দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিনিয়োগকৃত অর্থের একটি অংশ দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ সরকার। তবে এটির মালিকানা ২৫ বছর থাকবে থাইল্যান্ড ও চীনভিত্তিক ৩টি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। টোলও আদায় করবে তারা। কারণ এক্সপ্রেসওয়ের চুক্তিই করা হয়েছিল এভাবে।

চুক্তি অনুসারে, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নকশা প্রণয়ন, নির্মাণকাজের অর্থ জোগাড় করবে এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি চালুর পর তা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। ২৫ বছর পর বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিনিয়োগকারীরা এটি হস্তান্তর করবে। এর আগে টোল আদায় করে বিনিয়োগকৃত অর্থ সুদাসলে তুলে নেবে বিনিয়োগকারীরা। তবে দৈনিক সাড়ে ১৩ হাজারের কম গাড়ি চললে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে হবে।

এদিকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ছয় হাজার কোটি টাকার জমি বিনা মূল্যে দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এমনকি তারা টোলের কোনো অংশও পাবে না। শুধু তা-ই নয়, বরং এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে নির্ধারিত সময়ে নিচের জমি রেলওয়েকে হস্তান্তর করেনি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এতে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প আটকে আছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। জমি বুঝে না পাওয়ায় রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ করা যাচ্ছে না।

সূত্রমতে, ২০০৯ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে এটি ঢাকা বাইপাস করে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। তবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাতে আপত্তি জানায়। ঢাকার বাইরে নির্মাণ করলে লোকাল যানবাহন চলাচল করবে না; ফলে টোল আদায় ও নির্মাণব্যয় উঠবে না বলে আপত্তি তোলা হয়। এতে ঢাকার ভেতর দিয়ে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। এরপর রুট চূড়ান্ত করা ও নকশা প্রণয়নেই দুই বছর চলে যায়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে প্রথমে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে নির্মাণ চুক্তি সই হয়। ওই বছর ৩০ এপ্রিল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শুরুতে ইতাল-থাই কোম্পানির সঙ্গে ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকায় চুক্তি হয়। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করে এক্সপ্রেসওয়েটি চালু করার কথা ছিল। কিন্তু অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় সময়মতো কাজ শুরু করা যায়নি। এ ছাড়া ব্যক্তিগত জমি ব্যবহার কমাতে এর নকশায় কিছু পরিবর্তন আনার কারণে ২০১৩ সালে ২৩৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে চুক্তি সংশোধন করা হয়।

চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড (ভিজিএফ) নামে পরিচিত। ভিজিএফ হিসেবে ছয় কিস্তিতে সরকারের দুই হাজার ৪১৪ কোটি টাকা দেয়ার কথা। এক্সপ্রেসওয়েটি মগবাজার পর্যন্ত অংশের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর এ অর্থ ছাড় শুরু হবে।

অন্যদিকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে বলে প্রাক্কলন করা হয়। তবে সর্বনি¤œ যানবাহন চলাচল করতে পারে সাড়ে ১৩ হাজার। ৮০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করলে বাড়তি যে টোল আদায় হবে, এর ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পাবে। আর সেতু কর্তৃপক্ষ টোলের অংশ পেলে তা থেকে ১০ শতাংশ দেবে রেলওয়েকে। তবে দৈনিক সাড়ে ১৩ হাজারের চেয়ে কম যানবাহন চলাচল করলে বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারের।

চুক্তিতে বলা আছে, একটানা ১৫ দিন দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৩ হাজারের কম যানবাহন চলাচল করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিনিয়োগকারীকে চুক্তির চেয়ে বাড়তি সময় টোল আদায় করার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া চুক্তি অনুসারে, এক্সপ্রেসওয়েটি ২৫ বছর বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর মধ্যে নির্মাণ সময় সাড়ে তিন বছর। অর্থাৎ বিনিয়োগকারী সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করে অর্থ নিয়ে যাবে। আর বিনিয়োগকারীদের অধীনে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ফি হিসেবে পাবে মাত্র ২৭২ কোটি টাকা। তবে তা একবারে নয়, বছর বছর দেবে তারা।

এদিকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য রেলের দেয়া জমির পরিমাণ ১২৮ দশমিক ৩০৩ একর। রেলওয়ের হিসাবেই এর মূল্য ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিনামূল্যেই এ জমি দিয়েছে রেলওয়ে। এ বিষয়ে ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে তৎকালীন সড়ক ও রেলপথ বিভাগ এবং সেতু বিভাগ। তাতে বলা হয়, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রয়োজনীয় জমি দিতে রেলওয়ে কোনো আপত্তি তুলতে পারবে না। এ জমির বিনিময়ে রেলওয়ে নগদ কোনো অর্থও পাবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, ২০১১ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুই বিভাগের (সড়ক ও রেল) মধ্যে এ চুক্তি সই হয়। জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই হয়তো সে সময় এর বিনিময় মূল্য ধরা হয়নি। এ ছাড়া অব্যবহƒত পড়ে থাকায় বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। সে জন্যই হয়তো রেলওয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা এতে আপত্তি করেননি।

রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রেলের জমি হস্তান্তরে ১৯৯৮ সালের ১০ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর কোনো জমি বন্দোবস্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তার দাম হবে সংশ্লিষ্ট মৌজায় পূর্ববর্তী ১২ মাসের জমি বেচাকেনা দলিলের গড় মূল্যের তিন গুণ। এতে ১২৮ দশমিক ৩০৩ একর জমির দাম দাঁড়ায় ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০১৪ সালের মার্চে জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরুর আগে এ হিসাব করা হয়।

এমওইউতে বলা হয়, জমির লাইসেন্স ফির পরিবর্তে এক্সপ্রেসওয়ের আয়ের একটি অংশ পাবে রেলওয়ে। ২৫ বছর পর এক্সপ্রেসওয়ের মালিকানা সেতু বিভাগ পাওয়ার পর আদায়কৃত টোলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ রেলওয়ে পাবে। আর প্রথম ২৫ বছর টোল আদায় করবে বেসরকারি অংশীদার। সে সময় এক্সপ্রেসওয়েতে দৈনিক ৮০ হাজারের বেশি গাড়ি চললে আয়ের একটা অংশ পাবে সেতু বিভাগ। তার একটি অংশ পাবে রেলওয়ে।

এমওইউতে আরও বলা হয়, জমির ওপর অবকাঠামো নির্মাণেও কোনো আপত্তি থাকবে না রেলওয়ের। ৯৯ বছর বা তার বেশি সময় সেতু বিভাগ কিংবা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পরিচালনা করতে পারবে। এতে বাধা প্রদান বা ওই সময়ের মধ্যে জমি ফেরত চাইতে পারবে না রেলওয়ে। এ ছাড়া এমওইউর শর্তও কখনও ভঙ্গ করা যাবে না। তবে উভয় পক্ষ সম্মত হলে এমওইউর অন্যান্য শর্ত পরিবর্তন করা যাবে।

প্রসঙ্গত, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এতে ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির শেয়ার ৫১ শতাংশ। চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের মালিকানা ৩৪ শতাংশ। চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনো-হাইড্রো করপোরেশনের শেয়ার ১৫ শতাংশ। এদিকে ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ ও তার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরানো ও পরামর্শকদের ব্যয় মেটানোর দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। এ জন্য ‘সাপোর্ট টু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নামে আরেকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে সেতু বিভাগের। ২০১১ সালে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা।