নাসির উদ্দিন: লালমনিরহাটের মো. আলামিনের বয়স ১২ থেকে ১৩ বছর। অভাবের সংসারে ঠিকমতো খাবার জোটে না। চার ভাইবোনের সংসারের খরচ বাবার একার পক্ষে বহন করা অসম্ভব। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই কাজের খোঁজে ঢাকায় আসে আলামিন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা লেগুনার হেলপারের কাজ জোটে। দিনে ১০০ টাকার বিনিময়ে কাজে যোগ দেয় আলামিন। কয়েক দিন ভালোভাবেই কাটলেও কিছুদিন পর থেকে চালকের সঙ্গে তার বনিবনা হয় না। কারণে-অকারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। কাজশেষে তার সঙ্গে এখানে-ওখানে যেতে বলে। তার সঙ্গে না গেলে মারধর করে এবং তাকে আর কাজে রাখবে না বলে হুমকি দেয়। অনেকটা বাধ্য হয়েই আলামিনকে চালকের সঙ্গে নানা জায়গায় যেতে হয়। কিছুদিন পর আলামিনের আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়। নেশা করতে শুরু করে সে, রাস্তায় যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, আবার অনেক সময় তাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। কিছুদিন পর সে আর কাজে যায় না, বরং হেলপারি করা কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করে। কারণে-অকারণে নরম স্বভাবের হেলপারদের মারধর করে। দিনে দিনে তার অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়।
আলামিনের মতো অনেকেই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা সবাই আলামিনের মতো অভাবী নয়। অভাবের কারণে যে সবাই অপরাধী হয় তা নয়। ঢাকাসহ জেলা শহরের অনেকেই আছে, যারা শখের বশে কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তারপর গড়ে তোলে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং। কভিড-১৯ মহামারিতে এই অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বর্তমান সময়ে চরম উদ্বেগের বিষয়। কিশোর অপরাধীরাই আবার অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
যেসব কাজ প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, ওই ধরনের প্রচলিত আইন ভঙ্গকারী কাজ অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হলে সেটিকে কিশোর অপরাধ বলা হয়।
কিশোর বয়সের চাহিদা হলো নিজেকে প্রকাশ করা। আত্মপ্রকাশের চাহিদা তাদের কৌতূহলপ্রিয় করে তোলে। কৌতূহলের তারা বশে নতুন কিছু জানতে চায়, শিখতে চায়। এ স্বতঃস্ফূর্ত আকাক্সক্ষাকে যদি মা-বাবা, শিক্ষক ও অভিভাবক সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন, তবে এ ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যৎ জীবনে, কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে সফল মানুষ হয়। এ ছাড়া কিশোরদের অপরাধী হওয়ার নেপথ্যে আরও কিছু স্বভাবগত কারণ রয়েছে। যেমন মা-বাবার অযতœ-অবহেলা, উদাসীনতা, স্নেহহীনতা, সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদানে অমনোযোগিতা, পারিবারিক পরিমণ্ডলের ঝগড়া-বিবাদ, দারিদ্র্য, সুষ্ঠু বিনোদনের সংকট, সামাজিক অসাম্য, দুঃখ-দুর্দশা, যথাযথ তদারকির ঘাটতি, অবিচার, আশৈশব দুর্ব্যবহার প্রাপ্তি, কুসংস্কার ও কুসঙ্গ, অতি আদর, আর্থিক প্রাচুর্য ও অনিদ্রার মতো বিষয়গুলো কিশোরদের অপরাধী করে তোলে।
সামাজিক সমস্যা হিসেবে এবং অপরাধ জগতে কিশোর অপরাধ ক্রমবর্ধমানশীল। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি। বাংলাদেশের সার্বিক দিক বিবেচনায় কিশোর অপরাধ বা অপরাধীকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমন শহর এলাকার কিশোর অপরাধী, গ্রাম এলাকার কিশোর অপরাধী, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর অপরাধী ও উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোর অপরাধী। আর এসব কিশোর অপরাধীর মধ্যে প্রধানত যেসব অপরাধ লক্ষ করা যায় তা হলোÑজুয়া খেলা, নেশা করা, খেলার মাঠ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, বাস, ট্রেন ও সিনেমা হলে বিনা টিকিটে যাওয়া, পরীক্ষায় নকল করা, এসিড নিক্ষেপ, রাস্তাঘাটে ছিনতাই, মারপিট, অন্যের বাগানের বা ক্ষেতের ফল ও ফসল চুরি করা প্রভৃতি।
কিশোর অপরাধী হলো সেসব কিশোর-কিশোরী, যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজবিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণ সাত থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। তবে বিভিন্ন দেশে বয়সের তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ১৩ থেকে ২২ বছর, আবার কোনো দেশে ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে ১৪ বছরের, ফিলিপাইনে ৯ বছরের এবং ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে সাত বছরের কম বয়সী শিশুদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কৃত অপরাধের জন্য শাস্তি প্রদান না করে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়।
২০২০ সালের শেষ চার মাসে সারা দেশে কিশোর গ্যাংদের হাতে ১৭ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ১০টি থানায় ৩২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে এবং ৫০০ থেকে ৫৫০ সক্রিয় সদস্য ঢাকা শহরে নানা রকম অপরাধ সংগঠিত করছে। তাদের মধ্যে উত্তরায় আদনান হত্যা, দক্ষিণখানে মেহেদী হত্যা এবং শেওড়াপাড়ায় সজীব হত্যা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। এই দুটি কেন্দ্র থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরে সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য পাঠানো হয় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ওই দিন কেন্দ্র দুটিতে ছিল ৫৯৭ কিশোর। তাদের মধ্যে ১২০ জন হত্যা মামলার আসামি। ১৪২ জন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলা এবং ৯ জন তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলার আসামি। এর বাইরে চুরির মামলায় ৮৯, ডাকাতি ১৬, ছিনতাই ৬, মাদক মামলায় ৬৬, অস্ত্র মামলায় ২০ ও বিস্ফোরক মামলায় আছে ৫ জন। অন্যরা জিডিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি।
আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচারব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশুনীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এর পর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দেয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান শাখা শিশু (কিশোর-কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করে। পরিচালকের (প্রতিষ্ঠান) নেতৃত্বে অতিরিক্ত পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক সদর দপ্তর পর্যায়ে এবং মাঠপর্যায়ে তিন তত্ত্বাবধায়ক শিশু (কিশোর-কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জেলা পর্যায়ের তিন উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক মাঠপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং মাঠপর্যায় ও সদর দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি শিশু (কিশোর-কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ওই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন।
গাজীপুরের টঙ্গীতে বালকদের জন্য ৩০০ আসনের জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, কোনাবাড়ীতে বালিকাদের জন্য ১৫০ আসনের জাতীয় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র এবং যশোরের পুলেরহাটে বালকদের জন্য আরও ১৫০ আসনের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। কিশোর অপরাধ দমনে সরকার বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। অপরাধের ধরন বিবেচনায় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সেল গঠন করা হয়েছে, যেন অতি দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপরাধের শাস্তি এবং প্রতিকারে কী করণীয় তা প্রচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের গণযোগাযোগ অধিদপ্তর কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ যানবাহনে নৈতিকতার শিক্ষা প্রচার করা যেতে পারে। স্কুল-কলেজের সামনে বিভিন্ন বিলবোর্ডের মাধ্যমেও তা প্রচার করা যেতে পারে।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক প্রথম সাত বছর সন্তানকে মুক্ত রাখা, দ্বিতীয় সাত বছর তাকে শিষ্টাচার (আদব) শিক্ষা দেয়া এবং তৃতীয় সাত বছর তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই যদি তা অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়া যায়, তবে অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। এ কারণে ইসলাম মানুষের নৈতিক সুরক্ষার্থে কিশোরদের সুন্দর ও নির্মলভাবে লালন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলার কথা বলে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবার আগে পরিবার থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। বাবা-মায়ের সঠিক নির্দেশনা পেলে একটি শিশু ছোট থেকেই ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
আমাদের বর্তমান সমাজে পাঠাগার ও বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রম কমে গেছে এবং তাকে দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন ও আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সমাজে সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় কিশোর অপরাধ রোধ করার দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ স্কুলব্যবস্থার ওপর পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া দরকার, যা বিদ্যালয়গুলোকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমনÑমোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ও ইউটিউবের মতো গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই ওই গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই সন্তানের অবসর সময় কীভাবে কাটছে, তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবেই কিশোর অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।
পিআইডি নিবন্ধ