কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে সমগ্র দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। পরবর্তী ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধন অব্যাহত থাকে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। চুকনগর গণহত্যা একটি সামরিক গণহত্যা, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত করে। গণহত্যাটি ১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ঘটে, যা বিশ্বের কোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা।
ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নে চুকনগর বাজার অবস্থিত। বস্তুত ভদ্রা, কাজীবাছা, খড়িয়া, ঘ্যাংরাইল প্রভৃতি নদী ও শাখা নদীপথে এবং কাঁচা রাস্তায় দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রামপাল, তেরখাদা ও ফকিরহাট থেকে খুলনা, ডুমুরিয়া হয়ে চুকনগর ছিল সে সময়কার বিবেচনায় ভারতমুখী সর্বাধিক নিরাপদ পথ। চুকনগর ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ চুকনগরে লোকজন সীমান্ত অতিক্রমের জন্য এখানে এসে জড়ো হয়। এই সীমান্ত অতিক্রম শুধু শুধু জীবন বাঁচানোর জন্যই নয়। অনেকের লক্ষ্য ছিল ভারতে গিয়ে স্বদেশ ভূমিকে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রগহণের জন্য নাম লেখানো।
২০ মে বেলা ১১টা। পাকিস্তানি মিলিটারির বাহিনীর দুটি দল একটি ট্রাক ও একটি জিপ গাড়িতে এসে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই-তিনটি গাড়ি এসে থামে চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে ছিল হালকা মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। সাদা পোশাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালির (বিহারি) সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। ট্রাক থেকে নেমে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি কর্মমুখর ও ব্যস্ত এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। ওইদিন যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ হলেও অনেক নারী ও শিশুকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় অনেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই নদীতে ডুবে মারা যান। লাশের গন্ধে ভারি হয়ে যায় চুকনগর ও তার আশেপাশের বাতাস। এ রকম অনেক তথ্য পাওয়া যায় সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণীতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২০ মে সকাল ১০টা নাগাদ থেকে শুরু করে বেলা ৩টা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞটি ঘটে চুকনগরে। মাঠে, ক্ষেতে, খালে বিলে পড়ে থাকে লাশ আর লাশ। এ গণহত্যার পাশাপাশি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী যুবতী নারীদের ধর্ষণ করে। অনেক বাঙালিকে নিকটবর্তী ক্যাম্পে নিয়ে পরে নির্যাতন করে হত্যা করে। আবার যারা আহত হয়েছিল তাদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী চুকনগর থেকে চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিল চিল-শকুনের দল।’ চুকনগরে সেদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়। ভদ্রা নদীতে লাশ ফেলার দায়িত্ব দেয়া হয় অনেককে। প্রতি লাশের জন্য ৫০ পয়সা দেয়?া হবে বলে ঘোষণাও করা হয়। লাশের গায়ের স্বর্ণালঙ্কার ও সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ ওই ৫০ পয়সার গুরুত্ব ম্লান করে দেয়। ফসলি জমিতে আজও পাওয়া যায় গণহত্যার শিকার হাড়গোড়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চুকনগর গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক ফজলুল বারী জনকণ্ঠের এক নিবন্ধে লিখেছিলেন-‘লাশের ওপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ, স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল। বাবা মেয়েকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরেছিল। মুহূর্তে সবাই লাশ হয়ে যায়। ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের বহর, ভদ্রা নদী হয়ে যায় লাশের নদী। কয়েক ঘণ্টা পর যখন পাকিস্তানিদের গুলির মজুত ফুরিয়ে যায় তখন বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় মানুষগুলোকে।’
১৯৭১ সালে এদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তারাই অনুপ্রেরণা হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com