আশিকুর রহমান: বাল্যবিয়ে হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বিয়ে। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী ছেলের ২১ ও মেয়ের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হলে তা বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য হবে। আইনে বাল্যবিয়ে অপরাধ হিসেবে গণ্য হলেও তোয়াক্কা না করে হরহামেশাই বর্তমান সমাজে দিন দিন বেড়ে চলেছে এই অপরাধ। আইনের প্রতি অজ্ঞতার ভয়াবহ কবলে মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে এই বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে চোখ তুলে তাকালেই বাল্যবিয়ের অহরহ আয়োজন লক্ষ করা যায়।
‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’ অনুযায়ী, ছেলেদের বিয়ের উপযুক্ত বয়স ২১ এবং মেয়েদের জন্য ১৮ করা হয়েছে। এই নির্দিষ্ট বয়সের আগে বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া কোনো ছেলে-মেয়ে বিয়ে করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধে দণ্ডিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ধারা-৭ অনুযায়ী, দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে অর্থ অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। একই ধারার বিধানে অপ্রাপ্তবয়স্কের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ এক মাসের আটকাদেশ বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। বাবা-মায়ের অনুমতি, সম্মতি কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্কের ওপর কর্তৃত্বের ফলে বাল্যবিয়ে ঘটালে তা বলবৎ আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এই আইনের ধারা-৮ অনুযায়ী, শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড, কিন্তু ছয় মাসের কম নয় বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে অর্থ অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বা নিকাহ রেজিস্ট্রার বাল্যবিয়ে সম্পাদন করলে ধারা-৯-এর অধীনে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড, কিন্তু ছয় মাসের কম নয় বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে শাস্তির বিধান রয়েছে। এসব অপরাধের শাস্তি ‘মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯’ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট প্রদান করবেন।
অনেক পরিবার আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে বাল্যবিয়ে করাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে অধিকাংশ দিনমজুর অভাব-অনটনের ফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক প্রমাণ করার জন্য ভুয়া জš§নিবন্ধন, অবৈধ সনদ তৈরি করে বিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়। অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে সহজেই মেলে অবৈধ সনদ। জনসাধারণের এমন অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সমাজে অসাধু ও ভুয়া নিকাহ রেজিস্ট্রারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। নিকাহ রেজিস্ট্রারের অসদুপায় অবলম্বনের ফলে পরে ভুক্তভোগী হয় অসচেতন মানুষ। অনেক অভিভাবক সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মেয়েকে বিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে তারা আইনের বিধানের প্রতি খেয়াল না রেখে নারীর সুরক্ষায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জনসাধারণ আইন না জানার ফলে অসাধু নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজি অতিরিক্ত নিবন্ধন ফি নিয়ে ভুয়া সনদ তৈরি করে বিয়ে সম্পন্ন করে। এতে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়, তেমনই পরবর্তী সময় দেনমোহর কিংবা তালাকের সময় পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ রোধ করার উদ্দেশ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে সম্পূর্ণ বাল্যবিয়েমুক্ত করতে কাজ করছে। এমন অবস্থায় বাল্যবিয়ে বন্ধ করা না গেলে সরকার ও এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে না। এছাড়া ৭ অক্টোবর, ২০২০ ইউনিসেফ প্রকাশ করেছে ‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ: এ প্রোফাইল অব প্রগ্রেস ইন বাংলাদেশ’। এই রিপোর্ট অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সর্বাধিক এবং বিশ্বে সর্বোচ্চ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় বাবা-মা অসচ্ছলতার কবলে পড়ে নিজের পছন্দের ‘সুপাত্র’র সঙ্গে কন্যাশিশুর বিয়ে দেয় শুধু কালেমা পড়িয়ে। এতে পরবর্তী সময়ে কোনো ঝামেলা হলে আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ‘ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০১৯’ অনুসারে, ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ের হার বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ, আর ১৮ বছরের নিচে এ হার ৫১ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে অপরিণত বয়সে বিয়ের অপসংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে। অই অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন তোয়াক্কা না করেই অহরহ বিয়ে দেয়া হয়। ইউএনএফপি’র সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২০টি জেলায় দুই হাজার ৮২০ মেয়ের ওপর জরিপ করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জেলায় জেলায় বাল্যবিয়ের ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। যেমন রাঙামাটিতে বাল্যবিয়ে চার শতাংশ ও লক্ষ্মীপুরে ৪০ শতাংশ।
বাল্যবিয়ের কুফল ও আইন সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় প্রথার ভিত্তিতে কন্যাশিশুর অহরহ বিয়ে হয়। এতে একদিকে যেমন সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই অভিশাপে জড়িত ছেলে-মেয়েরা। অনেক সময় বিশেষ ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের জন্য আদালতের অনুমতি প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু অভিভাবক আদালতকে উপেক্ষা করে অনুমতি ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে আদালতের সরেজমিনে তদন্তের এখতিয়ার থাকলেও বিশেষ কারণ অনুসন্ধান ছাড়াই বাল্যবিয়ে হয়। বাল্যবিয়ে শিশু অধিকার লঙ্ঘন ও যৌন নির্যাতনের শামিল এ বিষয়ে না জেনেই অনেকে জোর করে বাল্যবিয়ে দিয়ে থাকে। কন্যাসন্তানের বয়স ১৫-১৯ হওয়ার সময় তারা বুলিংসহ নানা সহিংসতার শিকার হয়, ফলে অভিভাবকরা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে থাকে। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, সরকারের ২০২১ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) বলছে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৯ বছরের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন গর্ভধারণ করছে বা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। বাল্যবিয়ের অভিশাপটা শুধু মেয়ের জন্যই নয়, বরং এটি ছেলের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এই ঝুঁকি বেশি।
প্রচলিত আইনে কঠোর বিধান থাকা সত্ত্বেও সমাজে বাল্যবিয়ের হার কমছে না। এ অবস্থায় শুধু কঠোর বিধানই নয়, প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। বাল্যবিয়ে রোধে নারীদের শিক্ষা দান, অভিভাবককে বাল্যবিয়ের ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ভুয়া নিবন্ধন ঠেকাতে তালাক ও বিয়ে রেজিস্ট্রেশন অনলাইনভিত্তিক করা, অভিভাবকদের সচেতন হওয়া এবং বাল্যবিয়ে নিরোধে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল ও স্কুলে ক্যাম্পেইন করে জনসাধারণকে আইন সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
শিক্ষার্থী
আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়