নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার (লজিস্টিক) সেবা প্রদানে উদীয়মান (ইমারজিং) অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করছে। এতে সেরা ১০ উত্থানের (মুভার্স আপ) তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। পেছনে ফেলেছে উদীয়মান অর্থনীতির বেশকিছু দেশকে। ‘অ্যাজিলিটি ইমারজিং মার্কেটস লজিস্টিকস ইনডেক্স ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনটির তথ্যমতে, সূচকটিতে ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩। আর স্কোর ১০-এর মধ্যে পাঁচ দশমিক ১৫। গত বছরের তুলনায় লজিস্টিক সেবায় চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি স্কোর বেড়েছে দশমিক ২১। যদিও এ খাতে বাংলাদেশের আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রণয়ন করেছে যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপোর্ট ইন্টেলিজেন্স (টিআই) ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাজিলিটি। উল্লেখ্য, অ্যাজিলিটি বিশ্বের খ্যাতনামা লজিস্টিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। আর ট্রান্সপোর্ট ইন্টেলিজেন্স লজিস্টিক-বিষয়ক খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করে আসছে টিআই-অ্যাজিলিটি।
এ ক্ষেত্রে উদীয়মান দেশগুলোর লজিস্টিক সেবা, উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহন, শিপিং লাইন এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বিবেচনা করা হয়েছে। কমপক্ষে ২৫০ কর্মী রয়েছে এমন লজিস্টিক সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, লজিস্টিক সেবায় দ্রুত উন্নতি করছে এমন তালিকায় শীর্ষে অবস্থান মিশরের, যদিও সার্বিকভাবে দেশটির অবস্থান ১৪। শীর্ষ উত্থানের (মুভার্স আপ) তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কাতার, তৃতীয় বাংলাদেশ, চতুর্থ পাকিস্তান ও পঞ্চম থাইল্যান্ড। এর পর রয়েছে যথাক্রমে ইথিওপিয়া, ইরান, র্ভিয়েতনাম, চীন ও পেরু।
ব্যবসায়ীদের মতে, লজিস্টিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি বাস্তবসম্মত। বিদ্যমান সুবিধা যথাযথভাবে কাজে লাগানোর ফলেই এ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। অবকাঠামো সুবিধার আরও উন্নয়ন ঘটলে সূচকে আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে বিদ্যমান ভৌত ও অন্যান্য অবকাঠামো সুবিধা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরের দক্ষতা হয়তো বাড়েনি, কিন্তু বিদ্যমান দক্ষতার যথাযথ ব্যবহার হয়েছে। সব মিলিয়েই লজিস্টিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। আর ২০১৭ সালে পুরো বছর ব্যবসা-বাণিজ্য নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। সূচকে এগিয়ে যাওয়ার এটিও একটি কারণ। তবে এটা ঠিক আরও অনেক ভালো করা সম্ভব ছিল।
এদিকে লজিস্টিক সেবায় অবনমনের (মুভার্স ডাউন) দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ভেনিজুয়েলা। এরপর রয়েছে নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, কাজাখস্থান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ তালিকায় ছয় থেকে ১০-এ রয়েছে যথাক্রমে সৌদি আরব, কম্বোডিয়া, কুয়েত, শ্রীলঙ্কা ও অ্যাঙ্গোলা।
উল্লেখ্য, লজিস্টিক সেবা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি এমন একটি অপরিহার্য সেবা, যা আমদানি-রফতানির জন্য একটি দেশের ভেতর পণ্য পরিবহন, গুদামজাতকরণ, মালামাল জাহাজীকরণ, মোড়কীকরণ, নিরাপত্তা, বর্ডার ক্লিয়ারেন্স এবং পেমেন্ট ব্যবস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এই সেবা সরকারি ও বেসরকারি এজেন্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্ব লজিস্টিক নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ যে দেশের লজিস্টিক সেবার মান যত ভালো, সেই দেশে ব্যবসার খরচ তত কম। সে দেশের অর্থনীতিও তত দ্রুত উন্নতি করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, লজিস্টিক সেবায় সার্বিকভাবে শীর্ষে আছে চীন, যার স্কোর আট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত, স্কোর সাত দশমিক ১২। সাত দশমিক শূন্য এক পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, ছয় দশমিক ৬৩ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ মালয়েশিয়া ও ছয় দশমিক ৫০ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম ইন্দোনেশিয়া। শীর্ষ ১০-এর অপর দেশগুলো যথাক্রমে সৌদি আরব, রাশিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও তুরস্ক।
পূর্ণাঙ্গ সূচকটি তিনটি উপ-সূচকের ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়েছে। উপ-সূচকগুলো হলোÑলজিস্টিক সেবার বাজারের আকার ও প্রবৃদ্ধি আকর্ষণ (মার্কেট সাইজ অ্যান্ড গ্রোথ অ্যাট্রাকটিভনেস), লজিস্টিক সেবার বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা (মার্কেট কম্পাটিবিলিটি) এবং লজিস্টিক সেবার বাজারে যোগাযোগ সক্ষমতা (মার্কেট কানেকটেডনেস)।
লজিস্টিক সেবার বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নির্দেশ করে বিশ্বব্যাপী লজিস্টিক কোম্পানিগুলোর প্রদত্ত সেবাগুলোর তুলনায় সংশ্লিষ্ট দেশটির অবস্থান। এক্ষেত্রে একটি দেশের সেবা খাতের উন্নয়ন, নগরায়ণ, সম্পদের বণ্টন, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বাজার প্রবেশগম্যতা (এক্সেসিবিলিটি) ও নিরাপত্তা বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট ছয় দশমিক ৪৩।
আর যোগাযোগ সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সেবার মান বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জাহাজীকরণ (শিপিং) পৌনঃপুনিক হার (ফ্রিকোয়েন্সি) ও ক্রমবিন্যাস (রেঞ্জ), বাজারের আকার অনুযায়ী বিমানবন্দরের অবকাঠামো, পরিবহন অবকাঠামো এবং কাস্টমস ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ উপ-সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট তিন দশমিক ৯০। লজিস্টিক সেবার বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশের স্কোর চার দশমিক ৭২।
প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উদীয়মান ৫০টি দেশের সমুদ্র ও আকাশপথে বাণিজ্য লিঙ্ককে বিবেচনা করে পৃথক সূচক প্রণয়ন করা হয়েছে। এ সূচকে ২০০৫ থেকে ২০১১-এর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধিকে বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও শীর্ষ ২৫ উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে। তবে একক গন্তব্য হিসেবে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্যপথ।
এদিকে প্রতিবেদনের শেষদিকে বাংলাদেশের লজিস্টিক সেবার ক্ষেত্রে মন্তব্য হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অন্যতম ছোট অর্থনীতির দেশ। দেশটির যোগাযোগ সক্ষমতা, জাহাজীকরণ, আকাশ ও সড়কপথে যোগাযোগ অবকাঠামোর স্কোর অনেক কম। পাশাপাশি কাস্টমসের ক্ষেত্রেও বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। ফলে লজিস্টিক সেবায় দেশটি অনেক কম আকর্ষণীয়। এক্ষেত্রে উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে লজিস্টিক সেবায় সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
