Print Date & Time : 12 October 2025 Sunday 2:04 am

হাসনাবাদ ও দমদমা গণহত্যা

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে গোটা দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। পরবর্তী ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধন অব্যাহত থাকে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও, বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে  ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাস ধরেই পাকবাহিনীরা গণহত্যা সংগঠিত করে। তার মধ্যে ২৯ এপ্রিল সংগঠিত হয় ফটিকছড়ি হাসনাবাদ গ্রামের গণহত্যা ও ৩০ এপ্রিল দমদমা গণহত্যা।

হাসনাবাদ গণহত্যা: উত্তর ফটিকছড়ির নারায়ণহাট ও শান্তিরহাটের মাঝামাঝি  হাসনাবাদ গ্রাম। পাক-আর্মির আক্রমণের মুখে ভারতে যাওয়ার এটিই ছিল একমাত্র পথ। হাজার হাজার শরণার্থী রামগড় রোড দিয়েই ভারতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে উক্ত গ্রামের সম্মানিত ব্যক্তি শহীদ আমিনুল হক চৌধুরী ও মরহুম আবু তাহের চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয় মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সাধ্যমতো সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ খবর রাজাকারদের মাধ্যমে পাক-আর্মির কানে চলে যায়। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পাকবাহিনী হাসনাবাদ গ্রামের অদূরে নন্দীর স্কুলে ক্যাম্প স্থান করে। সকাল ১০-১১টার দিকে পাক-আর্মিরা প্রথমে একটি সেল ছুড়ে মারে। সেলটি আমিনুল হক চৌধুরীর আঙিনায় বিস্ফোরিত হয়। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ ছাপা পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়লে, পাক-আর্মির একটি দল ওই বাড়িতে ঢুকে  প্রথমে আমিনুল হক চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর ওই বাড়ির ৭ জন মানুষকে হত্যা করে তারা। সেখান থেকে আবুল কাশেম নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েও কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান। এরপর আমিনুল হক চৌধুরী ও আবু তাহের চৌধুরীর ঘরে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকবাহিনী এরপর হাসনাবাদ চৌধুরী বাড়ির পশ্চিমে আকবরপাড়া চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। সেখানে তারা ২ মহিলাসহ আরও ১৪ জনকে এনে ওই গ্রামের আজিজুর রহমানের পুকুর পাড়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এ ঘটনার কয়েকদিন পর ২৯ এপ্রিল স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা আহমদ ছাপাকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন পাকহানাদারদের হাতে ২২ জন শহীদ হন। সেই সঙ্গে আগুনে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, নারী ধর্ষণ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় হাসনাবাদ গ্রামটি।

যারা শহীদ হয়েছিলেন: আমিনুল হক চৌধুরী, ২. আব্দুর রশিদ, ৩. জেবল হোসেন, ৪. আলী আহমদ, ৫. দেলোয়ার হোসেন, ৬. আবু আহমদ, ৭. আব্দুল জলিল, ৮. মোর্শেদা খাতুন, ৯. কামাল পাশা, ১০. মোহাম্মদ কামাল, ১১. আজিজুর রহমান, ১২. তোফায়েল আহমদ, ১৩. টুনু মিয়া, ১৪. সখিনা খাতুন, ১৫. বশির আহমদ, ১৬. মোহাম্মদ আব্দুল সোবহান, ১৭. সিরাজুল ইসলাম, ১৮. আহমদ ছাপাসহ আরও অনেকে।

রংপুরের দমদমা গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল, এই দিনে পাকবাহিনী কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চার শিক্ষককে হত্যা করে। এই হত্যায় নেতৃত্ব দেয় কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার ও জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) রংপুর জেলা কমিটির তৎকালীন সভাপতি জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিচারাধীন নরঘাতক এটিএম আজহারুল ইসলাম। এদিন মধ্যরাতে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অতর্কিতে ঢুকে পড়ল পাকহানাদার বাহিনী। মুখ বাঁধা কয়েকজন অবাঙালি তাদের চিনিয়ে দিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের বাসাগুলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একেক করে ধরে নিয়ে আসা হলো অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কে। শুরু হলো অমানুষিক  নির্যাতন। তাদের মারতে মারতে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় দমদমা ব্রিজের কাছে। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করলে লুটিয়ে পড়েন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় এবং তার সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায়। মৃতদেহগুলো সেখানেই রেখে চলে গেলো পাকবাহিনীর গাড়ি বহর।

সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ৭ জুন আরও তিনটি ট্রাকে দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে দমদমা ব্রিজের কাছে লাইন করিয়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী।

১৯৭১ সালে এদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তারাই অনুপ্রেরণা হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে পথ দেখাবে।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com