সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা আসেÑ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। প্রিয় দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও লিবারেশন আর্মির প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’ মূলত তারপর সারাদেশে শুরু রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ছোট্ট শহর তুরা থেকে মাইল দশেক দূরে তেলঢালা বনভূমিতে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধানদের উপস্থিতিতে ‘জেড ফোর্স’ সামরিক ব্রিগেড গঠিত হয়। মেজর জিয়াউর রহমানের নামের আদ্যক্ষর জেড দিয়ে এই ফোর্সের নামকরণ করা হয়। এই ফোর্সের এক বিচিত্র সংযোজন ছিল স্টুডেন্ট প্লাটুন। তবে স্টুডেন্ট প্লাটুন নাম হলেও এর মাঝে ছিলেন একজন কৃষিশ্রমিক, একজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার, একজন ইপিআর, একজন ব্যবসায়ী ও একজন চাকরীজীবী। ৩৮ জনের এই প্লাটুনের বাকিরা ছিলেন মূলত কলেজছাত্র; চট্টগ্রামের নিজামপুর কলেজ, সিটি কলেজ, চিটাগং কলেজ ও নাজিরহাট কলেজের ছাত্র। তিনজন ছিলেন স্কুলের ছাত্র। এই তিনজনের ছিলেন সন্দ্বীপের দশম শ্রেণির ছাত্র ফরিদুল মাওলা, যিনি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর ৫৪টি বছর পার হলেও এখন অবধি বাংলাদেশের লাল মুক্তিবার্তায় নাম ওঠেনি তার।
মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল কাশেম (লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০২০৩৬০৩৬১) শেয়ার বিজকে বলেন, আমি আর আমার চাচাতো ভাই শহিদুল ইসলাম যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওনা হই। পথে দেখা হয় পাশের গ্রামের ফরিদুল মাওলার সঙ্গে। সেও এই উদ্দেশে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আমরা কলেজ স্টুডেন্ট হলে ফরিদ ছিল আমাদের ছোট। সবার উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে আসা, তারপর সেখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাওয়া। কিন্তু ওই সময় চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানো এত সহজ ছিল না। অনেক কষ্টে মাছ ধরার ট্রলারে করে শহরে আসি। তবে আমরা বিপদ এড়াতে ঘাটের আগে নেমে যাই, যাতে রাজাকার বা পাকিন্তানি আর্মিদের চোখে না পড়ি। আমাদের সঙ্গে সন্দ্বীপের আরও অনেকেই ছিল। তবে সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। আমরা তিনজনই নিজেরা পূর্বপরিচিত ছিলাম, যা যুদ্ধের শেষ অবধি আমরা কেউ নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাড়ি দেয়া, সেখান থেকে ট্রেনিং নেয়া, তারপর দেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাÑসবই একসঙ্গে করেছি। তবে আমার স্বীকৃতি মিললেও ফরিদুল মাওলা কোনো স্বীকৃতি পাননি। তার ফ্যামিলি অনেক দৌড়-ঝাঁপ করেছে, কিন্তু কোনো সুফল মেলেনি।
ফরিদুল মাওলার স্ত্রী শাহনেওয়াজ বেগম বলেন, আমার স্বামী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলেও লাল মুক্তিবার্তা তার নাম আসেনি। রাষ্ট্রীয় কোনো ধরনের ভাতা ও সুযোগসুবিধা পায়নি। তিনি জীবিত থাকতে এগুলো নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। বলতেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়। তিনি জীবিত থাকতে বেশিরভাগ সময় প্রবাসে ছিলেন। ২০০১ সালে মারাও গেছেন প্রবাসে। মূলত তার পর থেকে তিন সন্তান নিয়ে আমার কষ্টের জীবন শুরু হয়। নগদ অর্থ না থাকায় জমিজমা বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছি। একই সঙ্গে সব ধরনের ডকুমেন্ট দিয়ে জামুকায় আবেদনও করেছি, কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকলেও ‘ক’ তালিকায় তার নাম আসেনি, নাম এসেছে ‘খ’ তালিকায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে আপিলও করেছি। কিন্তু কোনো সুফল মেলেনি।
ফরিদুল মাওলার বড় ছেলে ইব্রাহিম খলিল শেয়ার বিজকে বলেন, বাবা একাত্তরের রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। স্বীকৃতি বা প্রমাণ হিসেব স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র রয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্দ্বীপ থানা কামান্ডের প্রত্যয়নপত্র রয়েছে। ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই আপিলে আব্বার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, এমন তিন লাল মুক্তিবার্তা নম্বরধারী সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষরও করেছেন। তারপরও তিনি ‘ক’ তালিকায় স্থান পাননি। ইব্রাহিম খলিল, আপিলের আপডেট জানতে আমি ২০২৩ সালে একবার জামুকাতে যাই। সেখানে এক কর্মকর্তা জানান, আপনাদের সব ডকুমেন্ট ঠিক আছে। তবে এভাবে হয় না। কিছু টাকাপয়সা খরচ করলে এক মাসের মধ্যে তালিকায় নাম এসে যাবে। তখন কিছু টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি আমায় জানান, লাখ পাঁচেক খরচ করতে হবে। তখন আমি চলে আসি। আমার প্রশ্ন, আমি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার সব ডকুমেন্ট সঠিক আছে। আমি কেন ঘুষ দেব!