অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রয়োজন

মেসবাহ উদ্দিন মিহির: বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান দুটি উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এই দুটি উৎসবকে ঘিরে শ্রমজীবী মানুষের কত স্বপ্ন গড়ে ওঠে। বিশেষ করে কাপড় ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক মৌসুম হলো এই ঈদের মৌসুম। এ সময় তারা সারা বছরের লাভ-ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বড় স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসায় নামে। ঠিক সেভাবে নেমেছিল রাজধানীর বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডে বিলীন হয়ে গেল তাদের রুটিরুজির মাধ্যমও। কয়েক হাজার পরিবার মুহূর্তেই হয়ে গেল নিঃস্ব। ক্ষতিগ্রস্ত হলো হাজারো ব্যবসায়ী এবং কর্মহীন হয়ে পড়ল প্রায় ৫০ হাজার কর্মী। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াল প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। অথচ যথাসময়ে অগ্নিনির্বাপণ করা গেলে হয়তো এই বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত।

বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও অসহায়ত্ব লক্ষ্য করা যায় অগ্নি দুর্ঘটনার সময়। কেননা অগ্নিকাণ্ডে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয় তার চাইতে বেশি ক্ষতি হয় উদ্ধার ব্যর্থতায়। দেশে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা সহজে নির্বাপণ করতে পারলেও বড় অগ্নিকাণ্ডের সময় দুর্বলতা স্পষ্ট  হয়ে ওঠে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নামক সংস্থাটির; যা ইতোমধ্যে বঙ্গবাজার, গুলশান, বসুন্ধরা, আমিনবাজার, পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড এবং সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে শুধু সরঞ্জামের অভাবে উদ্ধার ব্যর্থতায়। এখন কথা হলো, অন্যান্য ক্ষেত্রে দেশে প্রভূত উন্নতি সাধন হলেও শুধু অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থায় পিছিয়ে কেন? দেশে কেন অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম অপ্রতুল?

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে এলইউএফ সিক্সটি, ফায়ার বল, হাই ফগ, ফায়ার ফাইটিং রোবট, ফায়ার ফাইটিং ড্রোন, স্কাই সেইভার ও স্মার্ট ডিটেক্টরের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করছে, সেখানে আমাদের দেশে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি হিসেবে টিটিএল বা টার্ন টেবল লেডার ব্যবহার করা হয়। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনুন্নত। দেশে ১০-১২ তলা বা তার অধিক বহুতল ভবনে অগ্নিসংযোগ ঘটলে সেটা অল্প সময়ে নেভানোর মতো অত্যাধুনিক সরঞ্জাম নেই বললেই চলে অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তর বা ফায়ার সার্ভিসের কাছে। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প ও বন্যাসহ অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। কিন্তু এই অধিদপ্তরের জন্য সরকারি ব্যয় খুবই অপ্রতুল।

২০২১-২২ অর্থবছরে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে মাত্র ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সম্প্রতি সংস্থাটি অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিনসহ বেশকিছু যন্ত্রপাতি যুক্ত করেছে। বর্তমানে সংস্থাটির নিকট পানিবাহী গাড়ি রয়েছে ৬১৭টি। টোয়িং ভেহিকল রয়েছে ১ হাজার ৩২২টি। ফায়ার পাম্প ১ হাজার ৩৭০টি। অ্যাম্বুলেন্স ১৯২টি। উঁচু মইয়ের সংখ্যা ২৪টি। ফোম কেমিক্যাল হ্যাজমেট ও ব্রিদিং টেন্ডার ড্রোন ৩৫টি ও পাঁচটি টিটিএল মেশিন রয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়লেও সে হারে বাড়েনি এর জনবল সংখ্যা। বর্তমানে দেশে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সংখ্যা ৪৯৩টি এবং এর জনবল হলো মাত্র ১৪ হাজার ৪৪৩ জন। পর্যাপ্ত অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ও জনবলের অভাবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য এখনও সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সংস্থাটি। ফায়ারম্যানের সংখ্যা তুলনামূলক কম বা পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জামের অভাবকে অল্প সময়ে অগ্নিনির্বাপণে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হলেও   অধিকন্তু পানির অভাবে অগ্নিনির্বাপণ কাজ দুরূহ হয়ে উঠে সবসময়। তাদের রিজার্ভ পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর পানির উৎস অনুসন্ধান করতে করতে ব্যাপক সময়ক্ষেপণ হয়ে যায়, এতে ক্ষয়ক্ষতি আরও বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে কোথাও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার ফাইটারদের প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ায় পানির পাইপ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা এবং নিকটস্থ পুকুর বা জলাশয় অনুসন্ধান করা। বর্তমান সময়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে পর্যাপ্ত পুকুর বা জলাশয় নেই বললেই চলে। আর গুটিকয়েক পুকুর বা জলাশয় থাকলেও প্রতিনিয়ত তা ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে বড় বড় স্থাপনা। ফলে এখন কোথাও আগুন লাগলে পানি স্বল্পতার কারণে বিপাকে পড়েন দমকলকর্মীরা।

সরকারের উচিত হবে অগ্নিনির্বাপক ও উদ্ধারকারী অধিদপ্তরের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও অত্যাধুনিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা, যেন বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে দ্রুততার সঙ্গে স্বল্প সময়ে তা নির্বাপণে সক্ষম হতে পারে। প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে ফায়ারম্যানের সংখ্যা ও তাদের দক্ষতা উন্নয়নে যাবতীয় প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করা দরকার। অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে যেন পানি নিয়ে বিপাকে পড়তে না হয় তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা উচিত। যদিও সাধারণ মানুষকে অগ্নি দুর্ঘটনার বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী তৈরির নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আরও জোরদার করার মাধ্যমে মানুষকে অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন করতে হবে এবং অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলে তৎক্ষণাৎ করণীয় কী কী তা বুঝাতে হবে। এছাড়া বিপুলসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করতে হবে। যারা নিকটস্থ যেকোনো দুর্ঘটনায় বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উচিত দেশে নতুন স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা আরও জোরদার করার লক্ষ্যে সেইফটি প্ল্যান ঠিক আছে কিনা, যাচাই-বাছাই করে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ছাড়পত্র দেয়া। শর্ত পূরণ না করলে স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন না দেয়া। অমান্যকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

            শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়