রহমত রহমান: দেশের পোশাক ও অন্যান্য শিল্প-কারখানায় প্রায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় শক্তিশালী অগ্নিনির্বাপণ গড়ে তুলতে রেয়াতি সুবিধায় ‘ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট’ আমদানির সুযোগ দিয়েছে সরকার। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান এই রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আড়ালে নামমাত্র ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের সঙ্গে ‘এমএস পাইপ’ আমদানি করা হচ্ছে। গত তিন বছরে কেবল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের সঙ্গে আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ৬৮৯ মেট্রিক টন এমএস পাইপ, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ১৯৩ কোটি টাকা। এসব পাইপ প্রকৃত পক্ষে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা কাস্টমস জানে না। আবার রেয়াতি সুবিধার প্রজ্ঞাপনে কোন কোন পণ্যের সমন্বয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা’ হবেÑতার কোনো বিধান নেই। রেয়াতি সুবিধার আড়ালে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে এমএস পাইপ আমদানি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি শর্ত সংযোজন করতে সুপারিশ করে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত তিন অর্থবছর মোট ৮১ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে ১৪ হাজার ৬৮৯ মেট্রিক টন এমএস পাইপ (স্ক্যামলেস, উলডেড)। আবার আমদানি করা ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের শুল্কায়নযোগ্য মোট মূল্য প্রায় ৭৫৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। আর ফায়ার ইকুইপমেন্টের আড়ালে আমদানি করা এমএস পাইপের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ১৯৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছর ১১ হাজার ২২৫ মেট্রিক টন ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে দুই হাজার ৬৭ মেট্রিক এমএস পাইপ (স্ক্যামলেস, উলডেড)। আমদানি করা ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের শুল্কায়নযোগ্য মোট মূল্য প্রায় ৯৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যার মধ্যে এমএস পাইপের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছর ৪৫ হাজার ৮৫৮ মেট্রিক টন ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে ৪ হাজার ৯০৩ মেট্রিক এমএস পাইপ (স্ক্যামলেস, উলডেড)। আমদানি করা ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের শুল্কায়নযোগ্য মোট মূল্য প্রায় ৩৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যার মধ্যে এমএস পাইপের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ৫৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর ২৪ হাজার ৩৬৫ মেট্রিক টন ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে ৭ হাজার ৭১৯ মেট্রিক এমএস পাইপ (স্ক্যামলেস, উলডেড)। আমদানি করা ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের শুল্কায়নযোগ্য মোট মূল্য প্রায় ২৭৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যার মধ্যে এমএস পাইপের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ১১২ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এনবিআর সূত্রমতে, দেশের পোশাক খাতসহ সব শিল্প-কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ফায়ার ইকুইপমেন্ট আমদানিতে শর্ত সাপেক্ষে রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে এনবিআর। ২০২১ সালের ২৪ মে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় (প্রজ্ঞাপন নং-১২৯-আইন/২০২১/১৮/কাস্টমস, ২৪-০৫-২০২১)। প্রজ্ঞাপনে শর্ত-১ ও শর্ত-১১ যথাযথভাবে প্রতিপালনের বিধান রাখা হয়েছে। শর্ত-১ হলো, ফায়ার ইকুইপমেন্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইআরসি হোল্ডার ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট’ উৎপাদনকারী বা ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট সেবা প্রদানকারী হতে হবে। অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইআরসি হোল্ডার অর্থ হলো এমন প্রতিষ্ঠান, যার আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রবের দপ্তর থেকে ইস্যু করা হালনাগাদ শিল্প ভোক্তা আইআরসি রয়েছে। আর ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট হলো অর্থ হলো, মূসক আইন, ২০১২ ও বিধিমালা, ২০১৬-এর অধীনে নিবন্ধিত নিয়মিত দাখিলপত্র (রিটার্ন) দাখিল করে এমন উৎপাদনকারী বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।
অপরদিকে, শর্ত-১১-তে বলা হয়েছে, প্রত্যয়নপত্র মোতাবেক আমদানি করা পণ্য সংশ্লিষ্ট শিল্প বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হলে আমদানিকারক কর্তৃক দাখিল করা অঙ্গীকারনামা ফেরতযোগ্য হবে। অন্যথায় প্রযোজ্য শুল্ককর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে আদায় করা হবে। অর্থাৎ রেয়াতি সুবিধায় ফায়ার ইকুইপমেন্ট ছাড় নিতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কাস্টম হাউসের কাছে একটি লিখিত অঙ্গীকারনামা দিতে হয়। পরে কাস্টম হাউস সেই পণ্য ছাড় করে। একইসঙ্গে এসব অগ্নিনির্বাপণ পণ্যসংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে সংযোজন করেছে কি নাÑতা তদারকি করে প্রত্যয়নপত্র দিতে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটকে চিঠি দেয় কাস্টম হাউস। সেই চিঠি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ভ্যাট সার্কেল বা বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। আমদানি করা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সঠিকভাবে করেছে কি না, তা পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে একটি প্রত্যয়নপত্র দেয়। সেই প্রত্যয়ন হাউসে জমা দিলে প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীকারনামা ফেরত দেয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, কাস্টম হাউস থেকে তদারকি করতে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান তদারকি করা হয় না। প্রত্যয়নপত্র দেয়া হলে সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান অঙ্গীকারনামা ফেরত নিয়ে নেয়। সাধারণত বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছেন। আবার ছোট ছোট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ‘ম্যানেজ’ করে অঙ্গীকারনামা গায়েব করে ফেলে। যার ফলে এসব প্রতিষ্ঠান ফায়ার ইকুইপমেন্ট শিল্প-কারখানায় ব্যবহার করেছে কি না, তা জানা যায় না।
এ বিষয়ে ভ্যাট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, কাস্টম স্টেশন ও হাউস থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপণ স্থাপন করা হয়েছে কি না, তার তথ্য চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান যে হিসাব দেখায় তা কর্মকর্তাদের পক্ষে সঠিকভাবে যাচাই করাও দুরূহ হয়।
এনবিআরকে দেয়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস চিঠিতে বলেছে, আমদানি করা পণ্যসমূহের সমন্বয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ’ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবেÑএই বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে সুস্পষ্ট কোনো বিধান নেই। এই হাউস দিয়ে গত তিন বছর আমদানি করা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কিছু আমদানিকারক এই প্রজ্ঞাপনের আওতায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ‘আড়ালে’ নামমাত্র ‘ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট’-এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ এমএস পাইপ আমদানি করেছে। আমদানি করা পাইপ প্রকৃত পক্ষে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হচ্ছে কি না এবং প্রজ্ঞাপনের আওতায় আমদানি করা অন্য পণ্যগুলোর সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর হবে কি না, তা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্ধারণ করারও কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই।
আরও বলা হয়েছে, কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন সংস্থা কর্তৃক নিরীক্ষা ব্যতীত আমদানি করা পণ্যগুলো দ্বারা পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর হবে কি না, তা নির্ণয় করা জরুরি। আবার আমদানি করা পণ্যের সমন্বয়ে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপন পরবর্তী সরেজমিন পরিদর্শন করে বিশেষজ্ঞ মতামতের বিধান প্রজ্ঞাপনের শর্তে উল্লেখ নেই। তবে রেয়াতি সুবিধায় আমদানি করা পণ্য স্থাপন হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে ভ্যাট কমিশনারেট, বন্ড কমিশনারেটের মাধ্যমে সরেজমিন যাচাই পূর্বক নিশ্চিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু আমদানি করা পণ্যসমূহের সমন্বয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ’ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। সে জন্য প্রজ্ঞাপন সংশোধনে হাউস থেকে মতামত দেয়া হয়েছে।
যাতে বলা হয়েছে, প্রজ্ঞাপনে ‘পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা’ স্থাপনের শর্ত অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপন পরবর্তী কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন সংস্থা দ্বারা নিশ্চিত হওয়া বাস্তবসম্মত। সে জন্য শর্ত-৩ ও শর্ত-৭ সংশোধনে মতামত দেয়া হয়েছে। শর্ত-৩ অনুযায়ী, লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ী শিল্প বা সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার পরিবর্তে ‘লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ী শিল্প বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপন’ সংযোজন করার মত দেয়া হয়েছে। আর শর্ত-৭ অনুযায়ী, আমদানিকারক শিল্প বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করে নিশ্চিত হতে হবে। একইসঙ্গে আমদানিকারক নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের বিশেষজ্ঞ মতামত কাস্টম হাউসের কাছে দাখিল করবে। এই মতামত পাওয়া গেলে অঙ্গীকারনামা ফেরত দেয়া হবে। অন্যথায় প্রযোজ্য হারে শুল্ককর আদায় করা হবে।
চিঠিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান সম্প্রারিত হয়েছেÑএমন তথ্য দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আমদানি করে। তবে প্রতিষ্ঠান প্রকৃত পক্ষে সম্প্রসারিত হয়েছে কি না, তা কাস্টম হাউসের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত হয়েছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ভ্যাট অফিস সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন প্রেরণ করলে রেয়াতি সুবিধা প্রযোজ্য হবেÑশর্ত ৫-এর ক্ষেত্রে তা সংযোজনের মতামত দেয়া হয়েছে।