নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটশিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট হিসেবে দেখতে চায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। সেজন্য শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমাতে বাজেটে অগ্রিম আয়কর ও আগাম কর প্রত্যাহার এবং করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ বিষয়ে এনবিআর ও এফবিসিসিআই আয়োজিত এনবিআরের পরামর্শক কমিটির ৪৩তম সভায় এ আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এফবিসিসিআই সভাপতির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বক্তব্যে মো. জসিম উদ্দিন চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে এনে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুষম বিনিয়োগ-সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরনের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি।’ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবা এবং সিএমএসএমই’কে শুল্ককরের যৌক্তিক প্রতিরক্ষণ; ক্ষেত্রবিশেষে অব্যাহতি বা বন্ড সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ; নিত্যব্যবহার্য্য পণ্যমূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা; করনীতি, কর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণের মাধ্যমে করনেট বা কর জাল সম্প্রসারণ; স্বেচ্ছায় কর প্রতিপালন হার বৃদ্ধিপূর্বক রাজস্ব আদায় তথা কর জিডিপি’র অনুপাত বৃদ্ধি; আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা; মানবসম্পদ উন্নয়ন, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা এবং শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ নজর রাখার আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
তিনি রাজস্ব আহরণ এবং রাজস্ব পলিসি কার্যক্রম পৃথক করে এনবিআরের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বিভাগ গঠন, মুদ্রা পাচারে সহায়ক ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা পরিপন্থি বিদ্যমান ট্যারিফ মূল্য ও মিনিমাম ভ্যালু-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন রহিত করে তদস্থলে বিনিময় মূল্য সিস্টেম চালু; প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকদের প্রদত্ত বন্ড সুবিধার বাইরে অন্য রপ্তানিকারকদের জন্য কেন্দ্রীয় বন্ড ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; জমি ক্রয়, নির্মাণ এবং শিল্প ও সেবা খাতের ইউটিলিটি বিলসহ সব উৎপাদনশীল খাতে প্রদেয় যাবতীয় প্রশাসনিক সেবা সম্পূর্ণভাবে পরোক্ষ করমুক্ত রাখার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়ার আহ্বান জানান। এছাড়া আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি, তালিকাভুক্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, মৌলিক ও দেশে উৎপাদিত হয় না, এমন কাঁচামালের শুল্কহার এক থেকে তিন শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা; আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখতে তালিকাভুক্ত পণ্য বা সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা এবং জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশবান্ধব গাড়ির শুল্কহার হ্রাস করার আহ্বান জানান।
অপরদিকে মূসকের ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যন্ত ভ্যাট অফিসের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে সক্ষম ভ্যাট প্রদানকারীদের ভ্যাট নেটের আওতায় আনা, আমদানিকৃত উপকরণের ক্ষেত্রে তিন শতাংশ আগাম কর ধাপে ধাপে রহিত করা, নি¤œ আয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য্য পণ্য, সাধারণ পণ্য পরিবহন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্পের কাঁচামাল বা উপকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রি-সাইক্লিং, টেন্ডারবহির্ভূত সরাসরি পণ্য মেরামত বা সার্ভিসিং খাত প্রভৃতি ক্ষেত্রে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেয়া, করদাতাদের ব্যবসা পরিচালনা ও মূসক কর্তৃপক্ষেরও করদাতাদের তদারকি সহজ করতে ভ্যাট নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল, রিফান্ড, অডিটসহ সব কার্যক্রম করার ক্ষেত্রে অটোমেশন নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়। আয়করের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা এবং মহিলা ও সিনিয়র নাগরিকদের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকা করা, এসএমই শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য প্রিন্টিং শিল্প, প্যাকেজিং ও বাইন্ডিংয়ের সরবরাহকারীদের উৎসে আয়করের আওতাবহির্ভূত করা এবং সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় তালিকাভুক্ত ভোগ্যপণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতাবহির্ভূত রাখার প্রস্তাব করা হয়।
সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ব্যবসায়ীদের অনেক কষ্ট, আপনারা বুকে কষ্ট নিয়ে এখানে বসে আছেন। বাজেট সামনে রেখে অনেক সুপারিশ জমা হয়েছে। এগুলো আমরা লিপিবদ্ধ করেছি। আগামী বাজেটে নিশ্চয়ই সবদিক বিবেচনা করে বাজেট করা হবে, যেখানে আপনাদের কষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন, আমরা আগামীতে এমনভাবে বাজেট প্রণয়ন করব, যাতে কোনো ধরনের ঋণ নেয়া না লাগে। বাজেট হবে এমন যেন ঋণের প্রয়োজন না হয়, আগামীতে আর ঋণ নেব না। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা ধীরে ধীরে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ২০৪১ সালের স্বপ্নের সিঁড়িতে আছি। আসন্ন বাজেট হবে জনবান্ধব, বাজেট হবে জনগণের সুবিধার্থে।
সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আজকে শিল্পোদ্যোক্তারাই বলছেন, অনেক আইটেম স্বয়ংসম্পূর্ণ। এত দিন আমরা শিল্পকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিয়েছি, এখন সময় এসেছে আপনাদের সে প্রতিদান দেয়ার। অনেক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে লোড নেয়ার। সামনের দিনেগুলোয় আমাদের শিল্পকে এভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ফুয়েল, এনার্জি ও কাঁচামালÑএ তিনটি উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে এই তিন পণ্য দ্রুত ওঠানামা করে। আমদানিনির্ভর ফুয়েল, কাঁচামাল দিয়ে আমদানি করতে এ বিষয়গুলোকে মাথায় রাখতে হবে। রাজস্ব নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা ও রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে অটোমেশন করায় সম্পর্কিত ব্যবসায়ীদের তাগিদ দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এখনও অনেক জেলায় এনবিআরের পরিপূর্ণ অফিস নেই। জনবলের অনেক ঘাটতি আছে। এগুলো পূরণ করা প্রয়োজন। অন্য যেসব সমস্যা সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ চলছে।