রহমত রহমান: দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। সেবার সব ফি পরিশোধ করলেও ভ্যাট পরিশোধ করেনি অপারেটরটি। ভ্যাট পরিশোধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) তাগাদা দেওয়ার পরও ভ্যাট পরিশোধ করেনি। অজুহাত দেখিয়ে ভ্যাট পরিশোধে গড়িমসি করে আসছে গ্রামীণফোন।
বছর পার হলেও ভ্যাট পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। অবশেষে সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ভ্যাট পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর ওই ভ্যাট পরিশোধে সম্প্রতি গ্রামীণফোনকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে গ্রামীণফোনকে ১৫ দিনের সময় দিয়েছে। সম্প্রতি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) মূল্য সংযোজন কর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর সই করা চিঠি দেওয়া হয়।
চিঠিতে ‘২০১৯ সালের রেভিনিউ শেয়ারিং, স্পেকট্রাম চার্জ, সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসওএফ), বার্ষিক লাইসেন্স ফি টু-জি, থ্রি-জি ও ফোর-জি এবং স্পেকট্রাম অ্যাসাইনমেন্ট ফি ফোর-জি বাবদ বিটিআরসিতে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে বকেয়া মূসক পরিশোধের তাগাদা’ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি এলটিইউকে এ মূসক আদায়ে চিঠি দেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২২ জুলাই গ্রামীণফোনকে চিঠি দেয় এলটিইউ। এতে বলা হয়, বিটিআরসির চিঠি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গ্রামীণফোন ২০১৯ সালে রেভিনিউ শেয়ারিং, স্পেকট্রাম চার্জ, সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসওএফ), বার্ষিক লাইসেন্স ফি টু-জি, থ্রি-জি ও ফোর-জি এবং স্পেকট্রাম অ্যাসাইনমেন্ট ফি ফোর-জি খাতে বিটিআরসি’র বাবদ এআইটিসহ (অগ্রিম আয়কর) মোট এক হাজার ৩৪১ কোটি টাকা বিটিআরসিতে জমা দিয়েছে। এর বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট জমা দেওয়ার কথা ২২৩ কোটি টাকা। বিটিআরসি কর্তৃক উল্লিখিত বকেয়া মূসক গণনার ক্ষেত্রে এআইটিসহ মোট পরিশোধিত অর্থকে মূসক গণনার ভিত্তিমূল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু মূসক গণনার ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্যের মধ্যে এআইটি অন্তর্ভুক্ত হবে না। ওই ভ্যাট পরিশোধে গ্রামীণফোনকে কয়েক দফা তাগাদাপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট পরিশোধ করেনি।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বকেয়া মূসক পরিশোধ না করায় বিষয়টি বিটিআরসি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে জানায়। ডাক ও টেলিযোগাযোগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাগাদাপত্রের মাধ্যমে গ্রামীণফোন উল্লিখিত বকেয়া পাওনার মূসক অতি জরুরি ভিত্তিতে সরাসরি এনবিআরে জমা দিয়ে প্রমাণ বিটিআরসিতে দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। গ্রামীণফোন ও এনবিআরকে তাগাদাপত্রের কপি দেওয়া হয়। এরই মধ্যে এক বছর অতিক্রান্ত হলেও বকেয়া মূসক পরিশোধ করেনি গ্রামীণফোন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বকেয়া মূসক পরিশোধের জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
এর আগে ১৪ জানুয়ারি বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে দেওয়া একটি তাগাদাপত্রে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই এনবিআর থেকে বিটিআরসিকে মূসক নিবন্ধনের বিষয়ে জানানো হয়েছে, ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ধারা ৪ উপধারা ২ অনুযায়ী উৎসে কর্তনকারী সত্তা হিসেবে বিটিআরসি’র মূসক নিবন্ধন গ্রহণের প্রয়োজন নেই।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে কেবল তাদের পাওনা আদায় করবে। মূসক আদায়-সংক্রান্ত বিষয়ে এনবিআর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিষ্ঠানকে মূসকের অর্থ সরাসরি এনবিআরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তাতে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে রেভিনিউ শেয়ারিং ৫৩৮ কোটি ৭৬ লাখ ৪১ হাজার ৭৬২ টাকা। এআইটিসহ ৫৯৮ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার ৬২৪ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক ৮৯ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ২৯৪ টাকা। ৯ মাসে স্পেকট্রার্ম চার্জ ১১৪ কোটি ৫০ লাখ ৯৫ হাজার ৯৭৮ টাকা। এআইটিসহ ১২৭ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৬৪ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক ১৯ কোটি আট লাখ ৪৯ হাজার ৩৩০ টাকা। ৯ মাসে এসওএফ চার্জ ৯৩ কোটি ১৮ লাখ ২১ হাজার ৮৬৯ টাকা। এআইটিসহ ১০৩ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৩২ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক ১৫ কোটি ৫৩ লাখ তিন হাজার ৬৪৫ টাকা।
টুজি ও থ্রিজির ২০১৯-২০ সালের লাইসেন্স ফি ৯ কোটি টাকা। এআইটিসহ ১০ কোটি টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোট পরিশোধিত চার্জ ৭৫৫ কোটি ৪৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৯ টাকা। এআইটিসহ চার্জ ৮৩৯ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১২১০ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ১২৫ কোটি ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৮ টাকা। এর সঙ্গে বিলম্ব ফি ৭৫ লাখ সাত হাজার ৯৯৫ টাকা। একইভাবে ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামীণফোনকে আরও একটি তাগাদাপত্র দেওয়া হয়। তাতে মোট অপরিশোধিত ভ্যাট দাঁড়ায় ২২৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিক্যাশন মুহাম্মদ হাসান জানিয়েছেন, গ্রামীণফোন এ বিষয়ে বক্তব্য দেবে না। এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের হয়ে বক্তব্য দেবে এমটব।
এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম ফরহাদ (অব.) বলেন, ‘মোবাইল সেবাদাতারা সব সময়ই দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা জেনেছি, তাদের কাছে এনবিআর থেকে মূসক বা ভ্যাট প্রদান-সংক্রান্ত ডিমান্ড নোটিস আসছে। তবে বিটিআরসির মূসক গ্রহণের ক্ষেত্রে ভ্যাট নিবন্ধনের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই অনুরোধ মোবাইল অপারেটররা দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে। এই নিবন্ধন করা হলে তারা ভ্যাট প্রদান করতে পারবে।’
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, এলটিইউ ভ্যাট আইন অনুযায়ী ভ্যাট পরিশোধে চিঠি দিয়েছে। শুধু গ্রামীণফোন নয়, সব অপারেটরকে বকেয়া ভ্যাট পরিশোধে চিঠি দিয়েছে। এত দিন অজুহাত দেখিয়ে বিটিআরসির কাছে ভ্যাট জমা দেয়নি। এখন ভ্যাট আইন অনুযায়ী এলটিইউতে জমা দিতে হবে। অন্যথায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।