জাকারিয়া পলাশ: পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্র, মরুভূমি সৃষ্টিকর্তার দান। এগুলো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব সম্পদ থাকলে তার গুরুত্ব বোঝা যায় না। তবে না থাকলে বোঝা যায়। একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজস্ব সমুদ্রসীমা। নিজস্ব সমুদ্রসীমা না থাকলে সে দেশ অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে নানা সমস্যায় পড়তে হয় দেশটিকে। এ ধরনের দেশকে বলা হয় ল্যান্ডলক কান্ট্রি। বিশ্বে মোট ৪৪টি ল্যান্ডলক কান্ট্রি রয়েছে। এশিয়ার আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, লাওস, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও ভুটান ল্যান্ডলক কান্ট্রি। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের সমুদ্রসীমা নেই। এ কারণে দেশ দুটির আমদানি-রফতানি প্রতিবেশী ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৬ সালে নেপালের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হয়। ফলে ভারত নেপালে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। প্রায় অচল হয়ে পড়ে নেপালের পরিবহন ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ এদিক দিয়ে বেশ ভাগ্যবান। এদেশে নেপালের মতো বিশ্বখ্যাত হিমালয় পর্বত নেই। কিন্তু রয়েছে বঙ্গোপসাগর। দেশটির এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে। এ সমুদ্রসীমার মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, খনিজসম্পদসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ। সমুদ্রের নিচে কী কী সম্পদ রয়েছে, তার সব এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় কয়েক কোটি লোক বাস করে। তাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে। হাজার বছর ধরে উপকূলের মানুষ সমুদ্র থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু মাছ। আর এ ইলিশ ধরে শত বছর বেঁচে আছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ।
বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর হাজার বছর ধরে সমুদ্রসম্পদ দিয়ে এ দেশকে সহায়তা করছে। কিন্তু বিনিময়ে তেমন কিছু পায়নি। বরং প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে সাগর। দেশের ময়লা, আবর্জনা, বিষাক্ত কেমিক্যাল সব নদীপথে পড়ছে সাগরে। এতে সাগরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। সাগরের পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত করছে জ্বালানি তেল। প্রতিদিন সাগর দিয়ে পরিবহন হচ্ছে জ্বালানি তেল। ৪০, ৫০, ৬০ ও ৭০ বছরের পুরোনো অয়েল ট্যাংকার দিয়ে বছরের পর বছর জ্বালানি পরিবহন হয়েছে। পুরোনো ট্যাংকার দিয়ে চুইয়ে পড়েছে তেল। আর তা দূষিত করেছে দেশের সাগর ও নদীর পানি।
সাধারণ নিয়মে ৩০ বছরের বেশি পুরোনো অয়েল ট্যাংকার চলাচলের সুযোগ নেই। তবে আইনের ফাঁক গলে ৭০ বছরের পুরোনো অয়েল ট্যাংকারও চলছে দেশের নৌপথগুলোয়। প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক আইন মেনে ট্যাংকারের সর্বোচ্চ বয়স ২৫-৩০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। বাংলাদেশের ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩-এর ৩০ নম্বর ধারা অনুযায়ীও দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী জাহাজের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। এরপর দুবার বিশেষ ডকিং সার্ভে উন্নীত হলে সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলতে পারে অয়েল ট্যাংকার। কিন্তু উপকূলীয় তেলবাহী জাহাজের বয়সের বিষয়ে আইনে কিছু বলা না থাকায় ৭০ বছরের পুরোনো ট্যাংকারও চলছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশে নৌপথে চলাচলকারী ৪৫টি অয়েল ট্যাংকার রয়েছে, যেগুলোর বয়স ৪১ থেকে ৭০ বছর। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো অয়েল ট্যাংকারটির বয়স ৭০ বছর। ব্রিটিশ আমলে তৈরি টেকনাফ নামের ট্যাংকারটির মালিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। আর ৬৪ বছরের পুরোনো অয়েল ট্যাংকার জহরার মালিক আইডিএলসি। এছাড়া ৫৪ বছরের পুরোনো তিনটি অয়েল ট্যাংকার রয়েছে, যার দুটির মালিক বিআইডব্লিউটিসি। ক্যানাল ব্রিজ নামের ৫৪ বছরের পুরোনো অন্য অয়েল ট্যাংকারটির মালিক নজরুল ইসলাম অ্যান্ড কোং। এর বাইরে চল্লিশোর্ধ ৪৫টি ট্যাংকারের মধ্যে ১০টি বিআইডব্লিউটিসির হলেও সবই বেসরকারি কোম্পানির কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে সংস্থাটি।
সমুদ্রে চলাচলকারী নৌযানের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক অয়েল ট্যাংকার। কানাডা তার সমুদ্রসীমার একটি অংশে অয়েল ট্যাংকার পরিবহন আইন করে নিষিদ্ধ করেছে। তারা তাদের উপকূলের জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রিভেনশন অব পলিউশন ফ্রম শিপ (এমএআরপিওএল) অনুযায়ী তেলবাহী ট্যাংকারের বয়স নির্ধারণ করা আছে ২৫ বছর। এ কনভেনশনের রেগুলেশন ২০ অনুযায়ী এসব ট্যাংকারের সর্বনি¤œ ধারণক্ষমতা ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ডিডব্লিউটি। কিন্তু দেশের নৌপথে চলাচলকারী এসব ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা পাঁচ হাজার ডিডব্লিউটির কম হওয়ায় আইনের ফাঁক গলে চলাচল করছে ঝুঁকিপূর্ণ এসব অয়েল ট্যাংকার। আর এ কারণে অয়েল ট্যাংকার দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটছে। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর অয়েল ট্যাংকার ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে। ওই এলাকার জলজ পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ডুবে যাওয়া ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ছিল বালি ও পাথর পরিবহনের কার্গো। ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক কমোডর জাকিউর রহমান ভূঁইয়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা এক চিঠিতে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩, এমএআরপিওএল রেগুলেশন অথবা অন্য কোনো বিধানের আওতায় বাংলাদেশের অতিপুরোনো উপকূলীয় তেলবাহী ট্যাংকার চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো বয়সসীমা বিধিবদ্ধভাবে আরোপ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অতিপুরোনো অনেক তেলবাহী ট্যাংকার সমুদ্র উপকূল ও নদী এলাকায় চলাচল করছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে অর্ধশতাধিক অয়েল ট্যাংকার রয়েছে, যেগুলোর বয়স ৪০ বছরের বেশি। এসব অয়েল ট্যাংকার পরিচালনা করেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি মহল। তারা বিভিন্নভাবে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে চলছে। আইনের ফাঁকফোকর বের করে তারা এসব ট্যাংকারের চলাচলের বৈধতা বাড়াচ্ছে। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ অয়েল ট্যাংকারই এক স্তর কাঠামোবিশিষ্ট। জ্বালানি তেল পরিবহনে সারা দেশে অয়েল ট্যাংকার রয়েছে ২৫৬টি। এর মধ্যে ১৫৬টি বালুবাহী বাল্কহেড থেকে অয়েল ট্যাংকারে রূপান্তর করা। অর্থাৎ ৬০ শতাংশ অয়েল ট্যাংকারই তেল পরিবহনের উপযুক্ত নয়। এগুলোর সবই সিঙ্গেল বটম ও সিঙ্গেল হালবিশিষ্ট। এসব সিঙ্গেল হালবিশিষ্ট অয়েল ট্যাংকার প্রতিটিই সমুদ্রের জন্য একটি বড় আকারের জ্বালানি বোমা। যেকোনো সময় এগুলো দুর্ঘটনায় পড়ে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু সেদিকে কারও কোনো খেয়াল নেই।
পুরোনো অয়েল ট্যাংকারে জ্বালানি পরিবহন করলে একদিকে নৌপথ দূষিত হয় অন্যদিকে তেল অপচয়ের কারণে বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। দেরিতে হলেও বিপিসির নজরে এসেছে বিষয়টি। সম্প্রতি তারা স্রেফ জানিয়ে দিয়েছে, ৪০ বছরের পুরোনো ট্যাংকারে তেল পরিবহন করবে না তারা। গত কয়েক মাস পুরোনো ট্যাংকার ছাড়াই তেল পরিবহন করছে সংস্থাটি। এ সময়ে দেশের কোথাও জ্বালানি সংকট হয়নি। এ অবস্থায় তদবির শুরু করেছেন পুরোনো ট্যাংকার মালিকরা। তারা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে পুরোনো ট্যাংকারগুলোকে আরও পাঁচ বছর তেল পরিবহনের অনুমতি আদায় করেছেন। আর এ নিয়ে জ্বালানি বিভাগ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই।
বাংলাদেশে তদবির অনেক শক্তিশালী। তদবির করে এমপি, মন্ত্রী হওয়া যায়। মন্ত্রণালয় বশ করা যায়। এতে দেশ ও জাতির কী ক্ষতি হলো, তা কোনো বিষয় নয়। তদবির চলতে থাকলে একসময় হয়তো বিপিসি অবস্থান পরিবর্তন করবে। আবারও বাংলাদেশের নৌপথে চলবে ৫০, ৬০ ও ৭০ বছরের পুরোনো ট্যাংকার। আমাদের নৌপথ দূষিত হবে। আর সেটি যদি না হয় তাহলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে বিপিসি। সেটি ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে থাকবে।
সাংবাদিক