সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক লোকমান হাকিমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান জিরি সুবেদার স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। তিনি চট্টগ্রামের জিরি সুবেদার গ্রুপের চেয়ারম্যান। এ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি ভালো অবস্থানে থাকলেও অতিমুনাফার লোভে জড়িয়ে পড়ে। গত বছর পয়লা সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষা এবং অপব্যবস্থাপনার কারণে তার ইয়ার্ডে জাহাজ কাটা বন্ধ করে দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। এরপর একই ইয়ার্ডে অবৈধ ও অনুমোদন ছাড়া গোপনে বার্জ নির্মাণ শুরু করা হয়। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে ২০ লাখ টাকা।
সীতাকুণ্ড থানা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, জিরি সুবেদার স্টিল রি-রোলিং মিলসে গত বছরের ৩১ আগস্ট দুর্ঘটনায় দুই শ্রমিক নিহত ও ১৩ জন আহত হওয়ার ঘটনায় কারখানাটির কার্যক্রম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গত ১ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশে বন্ধ ঘোষণা করেন। আর পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্ঘটনার কারণ ও অন্যান্য বিষয়ে তদন্তের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিশেষ পরিদর্শক দল ইয়ার্ডে আসে। তারা এ ইয়ার্ডে কার্যক্রম পরিদর্শন করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয়।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শিপব্রেকিং ও রিসাইক্লিং আইন-২০১১ অনুসারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে নিরাপদ এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের মাধ্যমে জাহাজ কাটার নির্দেশনা না মানায় এ ধরনের দুর্ঘটনার ঘটছে। এতে দেশে ও বিদেশে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ না করায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই আইনটির ৪৫ ধারা অনুযায়ী কারখানাটির কার্যক্রম বন্ধ করা হলো।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোয় সাধারণত পুরাতন জাহাজ ভাঙার জন্য অনুমোদন থাকে। কিন্তু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে মেসার্স জিরি সুবেদার স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড নামের শিপইয়ার্ডে পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে বার্জ নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া যায়। সরেজমিন পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতা পায় অভিযানকারী দল। আর বার্জ নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ দূষণ করেছে। এ দায়ে মিলটিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ বিষয়ে গত ২ মার্চ শুনানি শেষে এ জরিমানার আদেশ দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন। তার স্বাক্ষরিত এক নোটিসে জরিমানার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গের দায়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী জিরি সুবেদারসহ মোট চার শিপব্রেকিং ইয়ার্ডকে ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এদিকে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, লোকমান হাকিমের মালিকানাধীন ফেরদৌস স্টিল করপোরেশন নামের শিপইয়ার্ড থেকে ৪০ কেজি লোহার ধাতব একটি বস্তু উড়ে আছড়ে পড়েছে আধা কিলোমিটার দূরে মিত্র বাড়িতে। এ ধরনের আরও দুটি লোহার বড় টুকরো পাশের জায়গায় এসে পড়ে। এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, যা উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ একাধিক টিম আসে।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায় শেয়ার বিজকে বলেন, শ্রমিক দুর্ঘটনার কারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনায় জিরি সুবেদার নামের জাহাজভাঙা কারখানাটির কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দুর্ঘটনায় দেশে ও বিদেশে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। ফলে শিল্প মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে আছে।

এ বিষয়ে জিরি সুবেদার স্টিল রি-রোলিং মিলস ও মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালক লোকমান হাকিমের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
উল্লেখ্য, মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক লোকমান হাকিম ১৯৯৪ সালে জিরি সুবেদার রি-রোলিং মিলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসায়িক জগতে বিচরণ শুরু করেন। এরপর জিরি সুবেদার শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, ফেরদৌস স্টিল করপোরেশন, নাহার স্টিল, নাহার ট্রেডিং করপোরেশন ও সুবেদার অক্সিজেন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আর এসব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন জিরি সুবেদার গ্রুপ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক লোকমান হাকিম দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ছয়টি পুরাতন জাহাজ আমদানি করে ২৮৯
কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। এর মধ্যে জিরি সুবেদার স্টিল রি-রোলিং মিলস আনে তিনটি জাহাজ। এতে ব্যয় হয়েছে ১৬৪ কোটি ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ৩২ টাকা। অপরদিকে ফেরদৌস স্টিল করপোরেশন আনে তিনটি জাহাজ। এতে ব্যয় হয়েছে ১২৪ কোটি ৯৬ লাখ ২২ হাজার ২৫৩ টাকা।