নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ব অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে অতিরিক্ত খাদ্য আমদানি করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার প্রধান এ নির্দেশনা দেন বলে বৈঠক শেষে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যেই পাঁচ দেশ থেকে খাদ্য আমদানির চুক্তি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শুধু এর ওপর নির্ভর না করে বিকল্প হিসেবে আরও কয়েকটি উৎসকে প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে শেষ মুহূর্তে কোনো জটিলতা না হয়।’
কভিড মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে খাবার ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দেশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডলারের দাম চড়ে যাওয়ায় বিলাস পণ্য আমদানি কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমাতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। এ সংকটের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম যেন আরও বেশি অস্থির না হয়, সেজন্যই খাদ্য মজুত ঠিক রাখার ওপর জোর দিচ্ছে সরকার।
গত শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে এক অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক সংকট বিবেচনায় রেখে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন তার সরকারের অগ্রাধিকার।
গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গ ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই মুহূর্তে দেশে ১৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি খাদ্য শস্য মজুত আছে। নভেম্বরে বিশ্বে যে খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা আছে, তাতে অনেক কমফোর্টেবল অবস্থায় আমরা আছি।’
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘রাশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে খাদ্যশস্য আনার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। রাশিয়া থেকে খাদ্য শস্য আনতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই গেল সপ্তাহে রাশিয়া থেকে সরকারিভাবে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এক্ষেত্রে প্রতি টনের দাম পড়বে ৪৩০ ডলার। মোট খরচ হবে ২১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সরকার এই গমের দাম রাশিয়াকে ডলারেই পরিশোধ করবে।
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বাংলাদেশ কীভাবে ডলারে দাম পরিশোধ করবে, তার ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি। তবে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে বিকল্পভাবে রাশিয়া থেকে কীভাবে আমদানি করা যায়, তা নিয়ে গত ২৫ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল।
রাশিয়ার পাশাপাশি ভারত ও ভিয়েতনাম থেকেও মোট ৮ লাখ ৩০ হাজার টন চাল ও গম কেনা হবে ‘জি টু জি’ পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ভারত থেকে এক লাখ টন ও ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টন চাল কেনা হবে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি শুরু হওয়ায় সুফল মিলেছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সম্প্রতি চালের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা কমেছে ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কারণে। এর ফলে একটা বড় সংকট মার্কেট থেকে সরে গেছে। অ্যাপারেন্টলি দেখা যাচ্ছে এটি একটি ভালো ফল দিচ্ছে। যেহেতু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আগামী দুই মাস বা পরবর্তীতে আর দুই মাস তিন-চার মাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হবে।’
ধারণা অনুযায়ী নভেম্বর থেকে বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিলেও বাংলাদেশের খুব বেশি সমস্যা হবে না বলে আশা করছে সরকার।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমরা একটা কমফোর্টেবল সিনারিও পেয়েছি। আমাদের ওয়ার্ক অর্ডার এবং খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা এসেছে। রাশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম থেকে চাল এবং গম নিশ্চিত হয়েছে।’
এরই মধ্যে আমন ধানও চলে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমন কম হলেও একটা বড় পোরশন (অংশ) আসবে। সব মিলিয়ে খাদ্য সিনারিওটা আল্লাহর রহমতে কমফোর্টেবল হবে। তারপর আরও দুই-একটা জায়গা থেকে খাদ্য ব্যবস্থা করে রাখতে বলা হয়েছে; কোনো রকমের চান্স নেয়া যাবে না। কোনো কারণে ধরেন দুই-একটা ওয়ার্ক অর্ডার যদি ফেইল করে, তাহলে অল্টারনেটিভভাবে অন্য জায়গা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে আমাদের মজুত যেন ঠিক রাখা যায়। যে পরিমাণ খাদ্য আমাদের গোডাউন থেকে যাবে, সে পরিমাণ খাদ্য এবং সেফটির জন্য আরও অ্যাকসেস কেনার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এখন যে চুক্তি বা এমইউ হয়ে গেছে, তার জন্য আর শর্টেজ হবে না (খাদ্য সংকট হবে না) আল্লাহর রহমতে।’
প্রধানমন্ত্রী খাদ্যের বিষয়ে কী বলেছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল বলেন, ‘উনি (প্রধানমন্ত্রী) স্পেসিফিকভাবে (নির্দিষ্টভাবে) বলেছেন, আমরা যে খাদ্য রিপ্লেসমেন্ট করছি- শুধু সেটার ওপর নির্ভর করা যাবে না। আমরা কমফোর্টেবল সিজনে থাকলেও আরও দুই-একটা জায়গা থেকে খাদ্য কেনার ইনিশিয়েটিভ নেয়া হোক। কোনো কারণে আল্লাহ না করুক চারজন বা পাঁচজনের মধ্যে কেউ যদি বলল যে আমি দিতে পারব না, তখন যাতে আমরা ঝামেলায় না পড়ি।’
এবার বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাত হয়েছে অর্ধেক, যাকে গত চার দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ বলছেন আবহাওয়াবিদরা। এ পরিস্থিতিতে দেশে আমনের চারা রোপণে বিলম্ব হচ্ছে, আবার রোপণের পর সেচও দেয়া কঠিন হয়ে গেছে বিদ্যুতের লোড শেডিংয়ের কারণে। এ বিষয়ে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, বৃষ্টি বা পানির শর্টেজের একটা প্রভাব হবে আমনে। তবে আমি নিজে বৃহস্পতিবার ১২ থেকে ১৩ জন ডিসির সঙ্গে কথা বলেছি, সিলেট থেকে শুরু করে নর্থবেঙ্গল পর্যন্ত। তারা বলেছেÑসম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকবে, সেটা থাকছে। সেটার কারণে আমনের সেচ ভালো হচ্ছে।’