পারভীন লুনা, বগুড়া: বছর পাঁচেক আগে দুই ছেলে আর এক মেয়েসহ বিলকিসকে ফেলে রেখে অন্য এক নারীকে নিয়ে পালিয়ে যান স্বামী জাহিনুর। স্বামী চলে যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন বছর ৪২ এর বিলকিস। ছেলেদের তখনও সংসারের হাল ধরার বয়স হয়নি। বিয়ে দিতে পারেননি একমাত্র মেয়ের। এমন এক সময়ে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে সংসার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পরেন বিলকিস।
কিভাবে সংসার চালাবেন, কিভাবে সন্তানদের মানুষ করবেন, কিভাবেই বা মেয়ের বিয়ে দিবেন সেসব ভেবে কূল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসাতেই সংসার চালানোর চিন্তা করেন বিলকিস। তার স্বামী জাহিনুরের ব্যবসা ছিল নারিকেলের ছোবরা প্রক্রিয়াজাত করে লেপ তোষকের দোকানে বিক্রি করা। কিন্তু ব্যবসা করতে প্রয়োজন মূলধনের। স্বজনদের কাছে দ্বারে দ্বারে ঘুরে তেমন টাকা মূলধন হিসেবে যোগাতে না তিনি। পরে অনেক ভেবে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋন নেন ৫০ হাজার টাকা। তারপর নিজেই শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারিকেলের ছোবড়া কিনে আনেন। এরপর মেশিনে এবং হাতে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি শুরু করেন। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয় না বিলকিসকে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাড়ি করেছেন এবং মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন বিলকিস আর একা নয়, তার এখানে কাজ করে আশে পাশের এলাকার আরও ৫ বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী। বিলকিসের নারিকেলের ছোবরা প্রক্রিয়াজাত করন কারখানায় দৈনিক পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে কাজ করেন তারা।
বগুড়া শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে আকাশ তারা (ধুমা পাড়া) এলাকায় বসবাস করেন বিলকিস বেগম। মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী ৯ শতাংশ জমি ১০ হাজার টাকা বাৎসরিক লীজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন নারিকেলের ছোবড়া প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানা। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচা ও শুকনো নারিকেল সংগ্রহ করেন তিনি। ১শ নারিকেল ১৫শ থেকে ১৬শ টাকা দরে কিনে আনেন। এরপর শ্রমিকদের দ্বারা গড়ে ১ হাজার নারিকেলের ছোবড়া ছাড়াতে খরচ হয় ৫শ থেকে ৬শ টাকা। ছোবা ছাড়ানো শেষে মেশিনের সাহায্যে সেগুলো মাড়াই করে রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হয় জাজিম, সোফা, শো-পিচ সহ বিভিন্ন জিনিস।নারিকেলের ছোবরার তোষ (কোকোপিট) অর্কিড গাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করেন বাগানিরা।
বিলকিস বেগম জানান, শহরের বিভিন্ন আড়ৎ থেকে নারিকেলের ছোবড়া কিনে আনেন তিনি। এরপর মেশিনে কেটে টুকরো করে দেন নিজেই। এরপর অন্য নারীরা হাত দিয়ে আঁশ ছাড়ানোর কাজ করেন। প্রক্রিয়াজাত করার পর এসব ছোবড়া বস্তায় ভরে ১৬০০ টাকা মন দরে বিক্রি করেন লেপ তোষকের দোকানে। এছাড়াও বিভিন্ন ফার্নিচারের দোকানেও বিক্রি করে থাকেন। তোষক তৈরী ছাড়াও সোফা সেট তৈরীর কাজে ব্যবহার হয় এসব নারিকেলের ছোবড়া। তবে শহরে দিন দিন নারিকেলের ছোবড়া ব্যবহার কমলেও গ্রামে এর চাহিদা রয়েছে অনেক। বর্তমানে অনেকেই এ ব্যবসার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। নারিকেলের ছোবড়া সারা বছর চলে না, বছরে ঈদ ও পূজায় এর সিজন থাকে। এ সময় ভালো চলে এবং শ্রমিকদের ব্যস্ততা তখন বেড়ে যায়। তার এ কাজে ৭/৮ জন শ্রমিক সারা বছর কাজ করে। তারা নারিকেল সংগ্রহ থেকে ছোবড়া বাজারজাতকরন পর্যন্ত কাজ করে।
৫০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করা ব্যবসায় এখন বিলকিসের পুঁজি ৬ লাখ টাকা। সংসারের খরচ আর ৭/৮ জন শ্রমিকের বেতন দিয়ে বছরে ৫০ -৬০ হাজার টাকা সঞ্চয় করেন তিনি।
তার কারখানায় কাজ করেন খোদেজা বেওয়া। তিনি বলেন, ১০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে বিয়ে করে অন্যত্র বসবাস করে। তিনি এই কারখানায় কাজ করে নিজের খরচ নিজে চালান। আরেক নারী আঙ্গুর বিবির স্বামী মুকুল মিয়া ২য় বিয়ে করে বসবাস করেন শহরে। মায়ের খবর রাখেনা ছেলেরাও। বাধ্য হয়ে তিনি নারকেলের ছোবড়া প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানায় কাজ করেন। এরকম ৫ জন নারীর কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন বিলকিস বেগম। বিলকিস বেগম জানান, আমার মত যে সকল নারীদের স্বামী নেই, তাদেরকে কারখানায় কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ব্যবসার পরিধি বাড়লে আরো নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান তিনি।
বগুড়া শহরের কানুছগাড়ি এলাকার সাদমান ফার্নিচারের মালিক কাঞ্চন বলেন, ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন কোয়ালিটির সোফা তৈরি করে থাকি। নারিকেলের ছোবরা দিয়ে আমরা সোফার গদি বানিয়ে থাকি। এই সোফাগুলির দাম ফোম ও তুলা দিয়ে তৈরি সোফার চেয়ে কিছুটা কম হওয়ায় আমরা কম দামে সোফা বিক্রি করতে পারি।
বগুড়া শহরের মাটিডালির ট্রি ওয়ার্ল্ড নার্সারির মালিক মিতু বলেন, আমরা নারিকেলের ছোবরার তোষ ৪০ কেজির বস্তা ২০০ টাকায় কিনে থাকি। এটি গাছের জন্য খুব উপকারী, বিশেষ করে অর্কিড গাছের জন্য এই নারিকেল ছোবলার তোষ (কোকোপিট) অনেক ভালো কাজে লাগে।