অধিকার সুরক্ষায় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রয়োজন জনসচেতনতা

মোছা. সাবিহা আক্তার লাকী :‘সবার জন্য প্রয়োজন, জন্ম ও মৃত্যুর পর পরই নিবন্ধন’এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ বছর ৬ অক্টোবর পালিত হয়েছে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবরকে ‘জাতীয় জন্ম নিবন্ধন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। পরে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ জন্ম এবং মৃত্যু নিবন্ধন সম্পন্ন করতে ‘জাতীয় জন্ম নিবন্ধন দিবস’কে ‘জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এ বছর দিবসটি উদ্যাপনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্টার জেনারেলের কার্যালয় কেন্দ্রীয় পর্যায়সহ তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনাসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস পালনের ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা তৈরিতে এক নতুনমাত্রা যোগ করবে।

জন্ম নিবন্ধন শিশুসহ বয়স্কদেরও একটি নাগরিক অধিকার। একটি শিশুর জন্ম নিজ দেশকে, বিশ্বকে আইনগতভাবে জানান দেয়ার একমাত্র পথ জন্মের পর জন্ম নিবন্ধন করা। প্রথম জন্ম নিবন্ধনের অধিকার জাতিসংঘের শিশু সনদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, এভরি চাইল্ড টু বি রেজিস্টার্ড ইমিডিয়েট আফটার বার্থ। বাংলাদেশের জাতীয় শিশু নীতি-২০১১ অনুযায়ী সব শিশুর জন্মের পর পরই জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। এটি শিশুর মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় অধিকার।

কয়েক বছর আগেও জন্ম নিবন্ধন করা হতো মূলত বহির্বিশ্বে গমন বা বিশেষ প্রয়োজনে। যদিও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন রয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকেই কিন্তু তার কার্যকারিতা ছিল খুবই নগণ্য। ১৮৭৩ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে প্রথম জন্ম ও মৃত্যুবিষয়ক একটি আইন পাস হয়। এখন সময় পাল্টেছে। দেশের সবমানুষকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের আওতায় আনতে ২০০১ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় প্রকল্প শুরু হয়। তখন হাতে লেখা জন্ম ও মৃত্যু সনদ দেয়া হতো। জন্ম ও মুত্যু নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সরকার তা বাধ্যতামূলক করেছে। এ লক্ষ্যে সরকার নতুন করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ (সংশোধিত ২০১৩) প্রণয়ন করে। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিশু অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে আইনটি ৩ জুলাই, ২০০৬ থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন অনুসারে, জন্ম নিবন্ধন হলো একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, মা-বাবার নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক রেজিস্টারে লেখা বা কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদান এবং জন্ম সনদ প্রদান করা। একইভাবে মৃত্যু নিবন্ধন হলো মৃতব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ, মৃত্যুর স্থান, লিঙ্গ, মাতা/পিতা বা স্ত্রী/স্বামীর নাম নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদানসহ ডেটাবেজে সংরক্ষণ ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রদান করা। সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের মেয়র বা মেয়র কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কাউন্সিলর বা অন্য কোনো কর্মকর্তা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং দূতাবাসসমূহের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো অফিসার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করে থাকেন। পাশাপাশি, ওয়েবসাইটেও (নৎ.ষমফ.মড়া.নফ) সংশ্লিষ্ট নিবন্ধকের কার্যালয় বরাবর অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করা যায়। আবেদনের প্রিন্ট কপি নিবন্ধন অফিসে দাখিল করলে নিবন্ধক জন্ম নিবন্ধন করতে পারবেন।

শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন ফ্রি। জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন পর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত নিবন্ধন ফি দেশে ২৫ টাকা, বিদেশে ১ ডলার। ৫ বছর পর নিবন্ধন ফি দেশে ৫০ টাকা, বিদেশে ১ ডলার। জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য আবেদন ফি দেশে ১০০ টাকা, বিদেশে ২ ডলার। অন্যান্য তথ্য সংশোধন এবং বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সনদের নকল সরবরাহের জন্য আবেদন ফি দেশে ৫০ টাকা, বিদেশে ১ ডলার। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় দেশে-বিদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের এ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

জন্ম নিবন্ধন করা থাকলে একজন শিশু বা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ বহু ধরনের সুবিধা পেতে পারেন। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ধারা ১৮ অনুযায়ী পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি রেজিস্ট্রেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, লাইসেন্স ইন্স্যুরেন্স পলিসিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। একইভাবে সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি, পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তি, মৃত ব্যক্তির লাইফ ইন্স্যুরেন্স দাবি, নামজারি ও জমিজমা প্রাপ্তিতে মৃত্যু সনদ জরুরি।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সব নাগরিকের একটি শুদ্ধ ডেটাবেস প্রস্তুতকরণে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন তথ্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে, সবার জন্ম নিবন্ধন করতে ২০১০ সাল থেকে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। সারাদেশে সরাসরি জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি অনলাইনেও নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। শুধু অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও সনদ ডাউনলোডই নয়, জন্ম নিবন্ধন যাচাইও করা যায় সহজেই। এখন যে কেউ মোবাইলে ‘জন্ম তথ্য যাচাই’ অ্যাপস ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন অনলাইন কপি যাচাই করে দেখতে পারেন। সরকারের এমন যুগান্তকারী উদ্যোগে বন্ধ হয়েছে দ্বৈত নিবন্ধন কার্যক্রম।

বর্তমানে সরকার দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশনগুলোর জন্য আলাদা আলাদা ৫টি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালাসমূহকে একীভূত করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা, ২০১৭ প্রণয়ন করেছে। পরে  ও মৃত্যু নিবন্ধন পদ্ধতি আরও সহজীকরণের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে প্রণীত বিধিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা, ২০১৮ জারি করা হয়, যা ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে পূর্বের নির্দেশিকা রহিত করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নির্দেশিকা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ফলে সাম্প্র্রতিক সময়ে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে মৃত্যু নিবন্ধনের সংখ্যাও। নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সূত্র অনুযায়ী জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমের শুরু থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ১৭ কোটি ৬৪ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩১ জনের। এর মধ্যে জন্মের ৫ বছরের মধ্যে নিবন্ধন হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ১ হাজার ২১১ জনের। ২০২০ সালে জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার ২৮ জনের। শুরু থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মৃত্যু নিবন্ধন হয়েছে ৯৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ জনের। এর মধ্যে ২০২০ সালে মৃত্যু নিবন্ধন হয়েছে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪০০ জনের।

বর্তমানে দেশ ও দেশের বাইরে মিলিয়ে ৫ হাজার ৫৩২টি জায়গা থেকে জন্ম নিবন্ধন করা যাচ্ছে। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের পাশাপাশি বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

এ কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে এবং এসডিজি এবং এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহে গৃহীত সিআরভিএস দশকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য রেজিস্টার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, স্থানীয় সরকার বিভাগ যুগান্তকারী কিছু উদ্ভাবণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখন স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত মাঠকর্মীদের নিকট থেকে নিবন্ধক কার্যালয়ের মাসিক সভায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিবন্ধক শিশুর জন্মের পূর্ব সময়ে পরিবারের নিকট অভিনন্দন বার্তাসহ জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফর্ম প্রেরণ করবেন। অনুরূপভাবে ইউপি সদস্য, গ্রাম পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির পর নিবন্ধক শোকবার্তাসহ মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন ফর্ম পরিবারের নিকট প্রেরণ করবেন। গ্রাম পুলিশ কর্মচারীর মাধ্যমে এই ফর্ম ও নিবন্ধন সনদ বিতরণ এবং আবেদনপত্র সংগ্রহ করা হবে। আশা করা যায়, এমন উদ্যোগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের সাফল্যে মাইলফলক স্থাপন করবে।

পিআইডি নিবন্ধন