Print Date & Time : 3 September 2025 Wednesday 9:20 pm

অনিয়মের পক্ষে মিছিলকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে

মোহাম্মদ আবু নোমান: রাজধানীর সদরঘাটে গত ৩০ ডিসেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করতে গেলে বিক্ষোভ মিছিল করে লঞ্চের শ্রমিক, মাস্টার ও ইঞ্জিনচালকদের সংগঠন। গোয়ার্তুমি ও চাপে একপর্যায়ে অভিযান স্থগিত হয়ে যায়। অভিযান চলাকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুটি লঞ্চের যাত্রা বাতিল করলে সদরঘাটের পন্টুনের ওপর বিক্ষোভ শুরু করেন শতাধিক শ্রমিক। গণমাধ্যমে এসেছে এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম ভূঁইয়া। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে থাকা সার্ভেয়ারের কাছে উত্তেজিত অবস্থায় নানা বিষয়ে জানতে চান। পরে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনিয়মের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি। কিন্তু নানা হুমকি-ধমকি শুনতে হয়। এখন তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আছেন। কিন্তু আমরা একা সদরঘাটে দায়িত্বপালনের সময় নিরাপত্তা নিয়ে হুমকিতে থাকি।’

আবারও প্রমাণ হলো সরকারের চেয়ে অপরাধীরা শক্তিশালী! এত চাপ যে, আইনও অসহায়! তাহলে আইন সবার জন্য সমান এমন সংলাপ কেন? অপশক্তির কাছে সত্য পরাজিত হওয়া খুবই দুঃখজনক। এ কারণেই বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। চাপ দিলেই আইন নাকচ। আইনের পাওয়ার লেস। আমরা মনে করি, কী করে নিরীহ মানুষের মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করা যায়, কঠোরভাবে এখনই তা নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি ডাক্তার কিছু বলা যাবে না, তিনি নার্স কিছু বলা যাবে না, তিনি অস্ত্রধারী সরকারি বাহিনির লোক কিছু বলা যাবে না, তারা মালিক সমিতির লোক, কেউ নৌ শ্রমিক, কেউ মোটরযান শ্রমিক কিছু বলা যাবে না। যখন অব্যবস্থাপনার জন্য শতাধিক মানুষ জীবন বিসর্জন দিল, কেউই বিক্ষোভ প্রতিবাদ জানাল না। যখন ওইসব অব্যবস্থাপনার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে, তখন সংশ্লিষ্ট নৌ-শ্রমিক, মালিক পক্ষ বিক্ষোভ মিছিল শুরু করল? আর সেই চাপে প্রশাসনও দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবে? দেশে যদি জবাবদিহিমূলক প্রশাসন থাকত তাহলে কখনোই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

আধুনিক বাংলা গানের জীবনমুখী ধারার কণ্ঠশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী। তার একটি গানে রয়েছে, ‘চোররাও দুদিন পর সংগঠন করবে।’  আমাদের অবস্থা যেন তা-ই।

শাহ আলম ভূঁইয়া পরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি মিছিলের নেতৃত্ব দিইনি; বরং আমি শ্রমিকদের ফেরত পাঠিয়েছি।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এখন মোবাইল কোর্টে অনিয়ম ধরা পড়ছে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার ও পরিদর্শকরা এত দিন কী করেছেন? তারা লঞ্চে পরিদর্শন না করেই ফিটনেস সনদ দেন।’

এখানে প্রশ্ন হলো, এই ত্রুটিযুক্ত নৌযান নির্মাণের জন্য দায়ী কে? ঘটনা ঘটার পরই ভ্রাম্যমাণ আদালত তৎপর কেন! তারা এত দিন [দুর্ঘটনার আগে] কোথায় ছিলেন? ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজ শুধু বিস্কুট, চকলেট আর শাবান-শ্যাম্পুর মোড়কে মেয়াদের তারিখ ঠিক আছে কি না, তদারকি করে বেড়ানো? দুর্ঘটনার জন্য প্রথমত দায়ী সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নয় কি? নৌযানের প্ল্যান পাস যারা করেন, সার্ভেয়ার যারা রয়েছেন, যাদের কাজ সরেজমিন পরিদর্শন করে নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে কি না দেখে সার্ভে সনদ দেয়া। কিন্তু তারা সরেজমিন পরিদর্শনে এসে, ‘ভরেজমিনে’ চোখ বুঝে অনুমোদন বা সার্ভেসনদ দিয়ে চলে যাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে কি? এরপর রয়েছে মালিকদের অতি লোভ, কম বিনিয়োগে অধিক ব্যবসা। তারা বিনিয়োগ বা খরচ কমানোর জন্য দুর্বল অবকাঠামো নির্মাণ, অপর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট দেয়া ও মানহীন অবকাঠামো নির্মাণ, অপ্রতুল জীবন রক্ষাকারী এবং অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম দিয়ে নৌযান প্রস্তুত করে, অসাধু কর্মকর্তাদের দিয়ে অনুমোদন নিয়ে বাম্পার ব্যবসার সুযোগ নিয়ে থাকে।

সব নৌযানে ঝুঁকি নিরসনের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার ফায়ার ড্রিল (আগুন নেভানোর মহড়া) করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাহাজগুলোতে এ বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এ কারণেই অগ্নিকাণ্ড যখন ঘটে, তখন সত্যিকার অর্থেই যথাযথভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকে না।

মিলনকে নিয়ে ৫০০ টাকার ফটোসেশন!

কিছু কাজের কোনো প্রতিদান হয় না। আবার টাকা দিয়ে উপকারের প্রতিদান পরিমাপ করাটাও ঠিক নয়। মিলন খান নিশ্চয়ই টাকার লোভে কিংবা পুরস্কারের আশায় কুয়াশাঘেরা শীতের রাতে মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। তাকে যদি সম্মান জানাতেই হয়, তবে কেন তার আর্থিক দিকটা বিবেচনা করে সেভাবে সাহায্য করা হলো না। সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর নদীতে ঝাঁপ দেয়া প্রায় ৩০০ যাত্রীকে বিনা ভাড়ায় পার করে দেয়া ট্রলারচালক মিলন খানকে পুরস্কার হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা দেন পুলিশ সুপার ফাতিহা ইয়াসমিন।

মিলনরা আছে বলেই আজও ‘মানবতা’ শব্দটি আছে, এরা আছে বলেই মানুষ স্বপ্ন দেখে ভালো মানুষ হবার, এরা আছে বলেই পৃথিবী শিক্ষা নেয়, মানুষের উপকার করার ইচ্ছে থাকলে টাকা পয়সা মুখ্য কিছু নয়। এরাই প্রকৃত বীর, প্রকৃত মানুষ। আগুনলাগা ওই লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা নদীতে সাঁতরে বেঁচে ফিরে আসা সঞ্জীব নামের এক যাত্রী গণমাধ্যমকে জানান, মাঝনদীতে তার পাশ দিয়ে একটি ট্রলার যাচ্ছিল। এ সময় তিনি চিৎকার করে সাহায্য চেয়ে আকুতি করেন। কিন্তু ট্রলারটি তাকে সাহায্য না করেই চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আরেকটি ট্রলারও একইভাবে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তিনি বলেন, ‘নৌকা যেতে দেখে আবার বাঁচাও! বাঁচাও! বলে চিৎকার করি। কিন্তু ওই নৌকার লোকজন আমাকে তীর দেখিয়ে বলে, পাড় খুবই কাছে। তারাও আমাকে আর নৌকায় তোলেননি। এরপর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে নদীতে ভেসে থাকার চেষ্টা করি। একসময় খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এরপর কোনোরকমে সাঁতরে তীরের দেখা পাই।’ যারা এ দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন, তাদের অনেকের ভাষ্য ছিল, জরুরি সেবায় ফোন দিয়েও সাড়া পাননি।

দেশের ৫০ শতাংশ লোকও যদি মিলনের মতো মানবতা থাকতো বাকী ৫০ শতাংশ লোকলজ্জায় ভালো হয়ে যেত। একজন মানুষ হিসেবে মিলন তার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে কাজ করেছে, ক’জনে করে এমনটা! তাকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া প্রয়োজন নয় কি? প্রধানমন্ত্রীকে তার গ্রামের এলাকার ভ্যানচালক সামান্য সময় ভ্যানে পরিবহনের কারণে যদি সরকারি চাকরি হতে পারে, তাও ভ্যানচালক স্বইচ্ছায় বা স্বপ্রণোদিত হয়ে নয়; আগে থেকে তাকে বলে-কয়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তাহলে ৩০০ মানুষের জীবন রক্ষা করা ট্রলার চালক মিলনকে কি জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত, সরকারি চাকরি অথবা আর্থিকভাবে হলেও মাত্র পাঁচ হাজার কেন, যথোপযুক্ত আর্থিক সহায়তা করা যেত না?

মিলন টাকার দিক থেকে গরিব কিন্তু মনের দিক থেকে ধনী। এখনকার সমাজে কেউ বিপদে পড়লে তাকে আরও চেপে ধরে কীভাবে আরও টাকা খসানো যায় সে চিন্তা করে। দেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলো প্রয়োজন না হলেও, এমনকি অভিযোগ রয়েছে মৃত্যু মানুষকে আইসিওতে রেখে লাখ লাখ টাকা বিল করে থাকে। এ সমাজে এত খারাপ মানুষের ভিড়ে মিলন যা করেছেন, তা প্রকৃত মানুষের চাক্ষুষ উদাহরণ। হাজারো-লাখো অমানবিকতার ভিড়ে একটি মানবিক দৃষ্টান্তের নাম ‘মিলন’।

সরকারের উচিত মিলনকে বড় ধরনের সম্মাননা দেয়া। মিলনরাই প্রকৃত বীর। মিলনরা ভাইরাল হয় না, মানুষের নাচানাচিতে ভাইরাল হয় বাদাম বিক্রেতা। যারা মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় মিলনকে দেখে তাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। দুনিয়াতে স্বার্থ ছাড়াও মানুষ আছে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিলন। সব মানুষের মন মানসিকতা যদি এমন হতো তাহলে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতো। মোবাইলে ক্যামরাবন্দি বা ভিডিও না করে আমাদের মিলন খান হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

ভালো কাজের পুরস্কারের বেলায় টাকার খুব অভাব। সরকারি একটি ‘বালিশ’ আর ‘জানালার পর্দার’ দামও নয়! অথচ সাবেক অর্থমন্ত্রী হলমার্ক গ্রুপের ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা বড় কোনো অঙ্ক নয়।’ এটা আমাদের সিস্টেম লস! সামনে মশার খবরের ছাড় নেই, পেছনে হাতি চলে গেলেও খবর নেই! নায়িকা-নর্তকীদের পেছনে এক রাতে ৫ লাখ টাকা খরচের মহতীদের অভাব নেই। অথচ মিলনের মহৎ কাজের পুরস্কার ৫ হাজার। একটু বেশি হয়ে গেল! না কম। পাঠকের হাতেই জাজমেন্ট থাকল।

দেশটা ভর্তি সাবরিনা, শাহেদ, মুরাদে। অথচ আমাদের দরকার ছিল মিলনদের। সত্যিকারের হিরোদের মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ গাড়ি থাকে না, কানাডায় বাড়ি থাকে না, সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে না। ঠিক যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কিছুই ছিল না। ভাতা পাওয়ার আশায় বা ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতকুর সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেÑএ আশায় কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, তেমনি টাকা পাওয়ার আশায় মিলন লঞ্চযাত্রীদের উদ্ধার করেনি। মিলনরাই আসল যোদ্ধা, আলোকিত যোদ্ধা। এসব মানুষকে জাতীয়ভাবে সম্মান দেয়া হোক। যাতে অন্যরাও ভালো কাজে এগিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের জন্য যেমন পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি মিলনদেরও এ যুগের মানবিকযোদ্ধা হিসেবে পুরস্কৃত করে সার্টিফিকেট দেয়া উচিত।

বিজয়ের মাসে আপনি [মিলন] পুরো জাতির হƒদয় জয় করে নিয়েছেন। সালাম হে জাতির বীর সন্তান এতগুলো পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। সশ্রদ্ধ সালাম প্রকৃত নায়ক!

সাংবাদিক

abunoman1972@gmail.com