অনিয়মের সঙ্গে ওঠাবসা প্রতিদিন

আকাশ মো. জসিম, নোয়াখালী: রসিকতা করে নিন্দুকরা বলেন, টাকা থাকলে জেলখানাও অনেকের কাছে শ্বশুর বাড়ি। আসলেই কি তাই? জানা গেছে, সমাজজীবনের সংঘটিত অন্যায়, অবিচার ও অনিয়মের দায়ে যেখানে শাস্তির জন্য পাঠানো হয়, খোদ সে জেলখানার ভেতরের অনিয়মের সঙ্গে ওঠাবসা। এমন চিত্র নোয়াখালী জেলা কারাগারের।

বেশ কয়েকদিন জেলে থেকে জামিনে বেরিয়েছেন আজাহার উদ্দিন। বললেন জেলখানার কিছু অনিয়মের কথা। আজাহার বলেন, ‘আমি সুস্থ থাকলেও টাকার বিনিময়ে কারাগারের হাসপাতালে আরাম-আয়েশে ছিলাম। কিন্তু সত্যিকারের যেসব অসুস্থ কয়েদি-হাজতি রয়েছেন তারা ঘুষ দিতে পারেন না বলে হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা পান না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারাগার হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা পেতে প্রতি মাসে একজন কয়েদিকে চুক্তিভিত্তিক কয়েক হাজার টাকা দিতে হয়। এ অর্থ বণ্টন করা হয় চিকিৎসক ও সুপারভাইজারের মধ্যে। যারা কারাগারের দীর্ঘদিনের সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারাই মূলত সুপারভাইজার হিসেবে পরিচিত। এসব সুপারভাইজার মেস হিসেবে পরিচিত। খুবই ক্ষমতাশীল হন মেচরা। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে কঠিন সমস্যায় পড়তে হয় কারাবন্দিদের। নতুন কোনো বন্দি তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে না চাইলে তাদের শোয়ার জায়গা হয় বাথরুমের পাশে। দেয়া হয় নোংরা ও ছেঁড়া বেডশিট।

এ ছাড়া অনেক হাজতির স্বজনদের রেখে যাওয়া খাবার ও দৈনন্দিন খরচের জন্য রেখে নগদ টাকা জমা নিয়েও নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। হাজতিরা অনেক সময় নগদ জমা ও খাবারের খবরই পান না। জানা গেছে, এসব জেলখানার কয়েক কর্মচারী ও মেসরা মিলে আত্মসাৎ করেন।

হাতিয়ার দলিল জানান, মাদক মামলায় তিন মাস জেল খেটে বের হয়েছেন সম্প্রতি। কারাগারের ভেতর টাকা দিলে সব মেলে। কারাগারের বাইরে যত শৃঙ্খলা কারাগারের ভেতর ঠিক ততই বিশৃঙ্খলা। যাদের টাকা আছে তারা এখানে সর্বোচ্চ সুবিধা পান। দলিল বলেন, আমি তিন মাসে কারাগারের ভেতর দেখেছি একটি সিগারেটের জন্য এক কয়েদি আরেক কয়েদির রাতভর পা টিপে দেন। শরীর ম্যাসাজও করে দেন।

সদর উপজেলার আবদুল জলিল ছেলেকে দেখতে এসেছেন কারাগারে। তিন ঘণ্টা পর তার সিরিয়াল এসেছে। ছেলের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলে কারাগার থেকে বের হয়ে আবদুল জলিল বলেন, ‘দশ টাকার টিকিট কেটে অপেক্ষা করেছি তিন ঘণ্টা। আর আমার অনেক পরে এসে ১০০ টাকার বিনিময়ে চার-পাঁচজন লোক তাদের লোকের সঙ্গে দেখা করে গেল। বাড়তি টাকা দিতে পারিনি বলে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে।’

কবিরহাটের জমির বলেন, ‘আমি এসেই আমার পরিচিত এক কারারক্ষীকে পাই। তাকে ১০০ টাকা দিই। তিনি সব ম্যানেজ করে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাকে দেখার সুযোগ করে দেন। আমি দিনে দু-তিন বারও দেখা করতে পারি। আমার এক স্বজনকে গত ছয় মাস ধরে এভাবেই দেখছি। এমন আরও অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়।’

সরেজমিন কারাগারের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে দেখা যায়, দর্শনার্থী যারা আসেন তারা কারারক্ষীদের ম্যানেজ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কারা ফটকের সামনে দাঁড়ানো দু’জন কারারক্ষীকে দেখা যায়। অপরিচিত কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এর মাঝে নাম-পরিচয় জানানো ছাড়াই চার-পাঁচজনকে দেখা যায় হাসতে হাসতে কারাগারে প্রবেশ করতে। পরে জানা যায়, তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোক। কারারক্ষীদের ম্যানেজ করা আছে বলেই তাদের পথ আটকায় না মূল ফটকের কারারক্ষীরা। অথচ শতাধিক দর্শনার্থী গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কারারক্ষীদের অনুমতি না থাকায় তারা প্রবেশ করতে পারেনি।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন কারারক্ষী জানান, প্রতি মাসে ডিসি একবার কারাগার পরিদর্শনে আসেন। যেদিন তিনি কারাগার পরিদর্শনে আসবেন, তার আগের দিন কয়েদিদের কোনো অভিযোগ-অনুযোগ না জানানোর জন্য হুশিয়ার করা হয়। কারা অভ্যন্তরে পরিপাটি করে সাজানো হয়, যেন ডিসি কোনো অনিয়ম না দেখেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে নোয়াখালী জেলা কারাগারের জেল সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যে কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ আছি। তারপরও কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পেলে অবশ্যই খতিয়ে দেখব।’