শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ : দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত বছর জানুয়ারিতে চালু হয় মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের বহুতল ভবনের ২৫০ শয্যার চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও লোকবল নিয়োগ না হওয়ায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা। নানা অব্যবস্থাপনা ও হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ে সেবাগ্রহীতারদের বিস্তর অভিযোগ। তবে সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মুন্সীগঞ্জ জেলার ১৮ লাখ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসারস্থল মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল। বিপুল জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিত করতে একটি আধুনিক ছয়তলা-বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ শেষে হাসপাতালটি ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু ১০০ শয্যার লোকবল দিয়েই ২৫০ শয্যার চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চলছে হাসপাতালটিতে। এতে সেবা নিতে এসে বিড়ম্বনায় পড়ছে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষ।
হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ৫৭ চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৪১ চিকিৎসক। নেই কোনো সিনিয়র কনসালটেন্ট। ৯৯ নার্স পদের স্থলে রয়েছে মাত্র ৫৬ নার্স। নেই কোনো দারোয়ান-নাইটগার্ড। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। এতে নানা অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ সেবাগ্রহীতাদের। এ ছাড়া লোকবল নিয়োগ না হওয়ায় নতুন ভবনে আইসিইউ ও সিসিইউসহ নানা ধরনের আধুনিক চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ সেবাগ্রহীতা চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। অভ্যন্তরীণ বিভাগে চিকিৎসা নেন প্রতিদিন অন্তত ৩০০ জন।
হাসপাতালটির বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের রুমে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিয়োগকৃত দালালদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। এমনকি খোদ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরাই ডাক্তারদের সঙ্গে আঁতাত করেই দালালদের লালনপালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে বহির্বিভাগের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। আরও জানা যায়, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালের কেবিনসহ জেনারেল বেডের বাথরুম সবকটিই অপরিষ্কার। টয়লেট ও পানির কল নষ্ট থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীদের। খাবারের পানিও কিনে খেতে হচ্ছে। হাসপাতালের অনেক বেডই ভাঙা, যেগুলো ঠিক আছে, তার অনেকগুলোরই বিছানা নেই। ভর্তি রোগীদের প্রতিদিনের বরাদ্দকৃত খাবার দেয়া হচ্ছে নিম্নমানের।
এদিকে হাসপাতালের কর্তব্যরত বহিরাগত ডাক্তাররা সরকারি টিকিটে (ব্যবস্থাপত্রে) ওষুধ লিখে দিলেও হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে অনেক জরুরি ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে রোগীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা গেছে। অনেকের অভিযোগ, টিকিটে (ব্যবস্থাপত্রে) লিখিত ওষুধ বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরের নার্স-ব্রাদাররা। এছাড়া হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওসুধ থাকা সত্ত্বেও আগত রোগীদের ভেতর থেকে ওষুধ না দেয়ার কারণে ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পরে বাইরের ময়লার স্তূপে ফেলে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি ওষুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার ১৮ লাখ মানুষ।
অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করে জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক আহম্মদ কবির বলেন, সরকারি লিখিত ব্যবস্থাপত্রে (টিকিটে) ওষুধ পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের বিষয়ে তিনি জানেনই না।
অপরদিকে হাসপাতালের নার্স-ব্রাদাররা গাইনি ডাক্তারদের যোগসাজশে প্রসবব্যথাসহ গাইনি-সংক্রান্ত নানা সমস্যা নিয়ে আসা প্রতিটি রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেয়ার কথা বলে বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেক রোগী। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করছেন অভিযুক্ত ডাক্তার ও সিনিয়র নার্স-ব্রাদাররা। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে করে তারা বলেন, এ হাসপাতালে দালাল ও টাকার বিনিময়ে কোনো কাজ করা হয় না।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আরিফুজ্জামান বলেন, ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল পরিচালনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক এবং ওষুধ কোম্পানির লোকদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ শুনেছি। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আহম্মদ কবির বলেন, ‘হাসপাতালের ডাক্তার ও জনবল সংকট মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও ভর্তি করা রোগীদের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র নার্স-ব্রাদার ও বহির্বিভাগের ডাক্তারদের অভিযোগের বিষয়টি অবগত হয়েছি। আমি শিগগিরই সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কোনো ধরনের অনিয়মের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হবে না। তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে দালারদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’