অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনে ঢাকার বায়ুদূষণ ভয়াবহ হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোর একটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরে নানা সমস্যা বেড়ে চলেছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা এর মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুবরণ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ধরনের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় বর্তমান বায়ুর মান যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ না নিলে বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

গতকাল বুধবার ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের সভা কক্ষে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএসএ’র এনভায়রনমেন্ট সিস্টেম অ্যানালিস্ট জোসেফ ম্যাকেনটায়ার এবং কানাডার ড. স্টিভেন জোনস। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের উদ্যোগে ঢাকা শহরের ১২ স্থানে বায়ুর মান যাচাই, যানবাহন গণনা এবং পর্যবেক্ষণ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

সেমিনারে বলা হয়, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, প্রতি ঘনমিটারে ১৭২ মাইক্রোগ্রাম। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫-এর উপস্থিতি ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। মিরপুর ১০-এ মূলত যান্ত্রিক যানবাহন, বিশেষত ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে এখানে বায়ুদূষণের মাত্রা মানদণ্ডের থেকে প্রায় তিন গুণ অধিক। অন্যদিকে লালবাগের বিসি দাশ সড়কে মূলত অযান্ত্রিক যান চলাচল করে এবং বায়ুদূষণের মাত্রা কম, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫-এর উপস্থিতি ৪০ মাইক্রোগ্রাম। গবেষণায় দেখা যায়, যান্ত্রিক যানের আধিক্য বায়ুদূষণের জন্য দায়ী এটি সহজেই অনুমেয়। যান্ত্রিক যান, বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘ঢাকা শহর বসবাস যোগ্যতা হারানোর জন্য বায়ুদূষণ অনেকাংশে দায়ী। আমরা হাঁটা, গণপরিবহন এবং অযান্ত্রিক যানকে উপেক্ষা করে যাতায়াত পরিকল্পনা করায় বায়ুদূষণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গবেষণাটি বর্ষাকালে সম্পাদিত হয়েছে। এ সময় বায়ুদূষণের পরিমাণ কম হয়। এ সময়েই তা মানদণ্ডের থেকে অধিক। শীতকালে যখন দূষণ বেশি হয়, তখনকার ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়।’

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দিন হাসান বলেন, ঢাকায় যানবাহনজনিত বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ভূমির মিশ্র ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সেই সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ এবং গণপরিবহন, হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের সুবিধা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (আইটি এবং প্রচার) ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘বায়ুদূষণ প্রতিরোধ পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকারি পর্যায় থেকে আরও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। নগরে যান্ত্রিক যান বৃদ্ধির ফলে বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণ দুটিই অত্যন্ত ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে। যান্ত্রিক যানবাহনের আধিক্য বিশেষ করে এর হর্ন শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতর কাজ করছে এবং এর সঙ্গে সবাইকে যুক্ত হতে হবে।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘দূষণমুক্ত পরিবেশ আমাদের অন্যতম চাহিদা। প্রত্যেকে যদি বায়ুদূষণের ভয়াবহতা চিন্তা করে যান্ত্রিক যান ব্যবহারে সচেতন হয়, তাহলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। বায়ুদূষণ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের উপদেষ্টা সেমিনারের সভাপতির বক্তব্যে দেবরা ইনফরমেশন বলেন, ‘আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থায় যান্ত্রিক যানকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে দূষণ এবং যানজট দুটিই বেশি। বিশ্বের যেসব শহর বসবাস যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়, তারা যান্ত্রিক যানের পরিবর্তে হাঁটা এবং সাইকেলিংকে প্রাধান্য দিচ্ছে। রাস্তা বাড়ানোর দিকে জোর না দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।’

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ হোসেন সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন। সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল হক, সিপিডিপির প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর আফসানা আজাদ, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিইংয়ের মাসুম বিল্লাহ ভূইয়া, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের সহকারী প্রকল্প কর্মকর্তা তালুকদার রিফাত পাশা, মডার্ন ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, স্পেসের সোলায়মান কবির প্রমুখ।