রহমত রহমান: বিপণন ও বাজারজাত করে অনুমোদনহীন এনার্জি ড্রিংক। কিন্তু প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিতে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। একাধিক ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। বিএটিবির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘আগামী লিমিটেড’ রিচার্জ নামের এই ইলেক্ট্রোলাইট এনার্জি ড্রিংকস দীর্ঘদিন ধরে বাজারজাত করে আসছে। আগামী লিমিটেডে বিএটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনীম ও বিএটিবিবির আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রেরণা ফাউন্ডেশনের শেয়ার রয়েছে। লোকচক্ষুর আড়ালে আগামী লিমিটেড নাম দিয়ে এই ক্ষতিকর এনার্জি ড্রিংক বাজারজাত করছে বিএটিবি। শুধু বিএটিবি নয়, আরও চারটি প্রতিষ্ঠান একইভাবে অনুমোদনহীন এনার্জি ড্রিংক বাজারজাত করে আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
‘রিচার্জ’ নামীয় এই এনার্জি ড্রিংকের বিরুদ্ধে মামলার বাদী হলেনÑপ্রসিকিউটিং অফিসার, নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কামরুল হাসান। মামলার বাদী আদালতকে বলেছেন, ‘রিচার্জ অরেঞ্জ রিভাইড ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস’-এর লেবেলের গায়ে লেখা রয়েছে খেলাধুলা ও ব্যায়ামের পর ক্লান্তি দূর করে। এছাড়া আর্দ্রতা, আবহাওয়া, পানি শূন্যতা দূর করে। ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘অনুমোদনহীন’ এই পণ্যের বিভ্রান্তিকর অভিব্যক্তি ও পণ্যের মোড়কের গায়ে বিভিন্ন রোগের সুস্পষ্ট ভাষায় মতামত প্রকাশ করা হয়েছে, যা নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ ও মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা, ২০১৭-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরও বলা হয়েছে, রিচার্জ অরেঞ্জ রিভাইড ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক বিজ্ঞানসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই পণ্য বিএসটিআই অনুমোদিত নয় এবং পণ্যের লেবেলে বিএসটিআইয়ের কোনো লোগো নেই। কোনো খাদ্য পণ্য উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রয় করতে হলে বিএসটিআই এবং ওষুধ হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু দুই জায়গা থেকে অনুমোদন না নিয়ে মোড়কজাত ও সারাদেশে বাজারজাত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই পণ্য অনিয়মের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়েছে। রিচার্জ অরেঞ্জ রিভাইড ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতামত নেয়া হয়েছে। অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকের বিষয়ে তাদের থেকে কোনো অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেয়া হয়নি।
অপরদিকে, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে আগামী লিমিটেড নিবন্ধন নিতে দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিকানা ট-১৩১, ওয়াকিল টাওয়ার (এল/৮), মধ্যবাড্ডা লিংক রোড, ঢাকা-১২১২। আরেক ঠিকানা হলো ৫৫/বি, ২য় তলা, রোড-২১, বনানী, ঢাকা। তবে এই দুই ঠিকানায় আগামী লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। এই দুই ঠিকানায় বিভিন্ন নামীয় প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। শুধু নেমপ্লেট রয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা রয়েছে। আর রয়েছে কয়েকটি চেয়ার। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নেই। দুটি বিল্ডিংয়ের কর্তব্যরতদের মতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুধু নেমপ্লেট ব্যবহার করা হয়। বহু প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে একই কক্ষে রয়েছে। কয়েকটি চেয়ার ছাড়া কিছুর অস্তিত্ব নেই। এখানে শেষ নয়, আগামী লিমিটেডের ১০০ শেয়ারের মালিক বিএটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনীম। আর ৯ হাজার ৯০০ শেয়ারের মালিক বিএটিবির আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রেরণা ফাউন্ডেশনের। প্রেরণার মনোনীত প্রতিনিধি হিসাবে আগামী লিমিটেডে আছেন বিএটিবির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মুবীনা আশাফসহ তিনজন। মূলত প্রেরণা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা বা বিএটিবির কর্মকর্তারাই আগামী লিমিটেড পরিচালনা করেন। তবে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের মহাখালীর সেনাকল্যাণ টাওয়ারে যে ঠিকানা দিয়েছে, সেই ঠিকানায় প্রতিষ্ঠান নেই।
সূত্রমতে, বিএটিবির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রেরণা ফাউন্ডেশন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বিএটিবি প্রেরণা ফাউন্ডেশনে অর্থায়ন করে। আগামী লিমিটেড প্রেরণা ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে আগামী লিমিটেড বিএটিবির একটি প্রতিষ্ঠান। আগামী লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সরজিৎ বড়াল। তিনি বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একজন প্রকল্প কর্মকর্তা। এছাড়া আগামী লিমিটেড পরিচালনায় রয়েছে বিএটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনীম। এছাড়া রয়েছে সৈয়দ মাহবুব আলী ও মুবিনা আশরাফ। এই দুজন প্রেরণা ফাউন্ডেশনের। বিএটিবির ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিএটিবি থেকে আগামী লিমিটেড থেকে ২০২২ সালে ৩৪ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৪৫ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা কিনেছে বিএটিবি। এই দুই বছরে আবার সেই প্রতিষ্ঠানকেই সামাজিক খাতে ১৮ কোটি টাকা করে মোট ৩৬ কোটি টাকার ডোনেশন দিয়েছে বিএটিবি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাঁচটি কোম্পানি অবৈধভাবে অনুমোদনহীন, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এনার্জি ড্রিংক বাজারজাত করেছে। ইতোমধ্যে একটি কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা দেয়ার পর যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কর্মকর্তারা বলেন, অনুমোদন ছাড়াই রিচার্জ ইলেকট্রোলাইট এনার্জি ড্রিংকস বাজারজাত ও বিক্রি করে আসছিল আগামী লিমিডেট। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির এই পণ্যসহ পাঁচটি ইলেকট্রোলাইট এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
অপরদিকে, কোম্পানিগুলো বলছে, ইলেকট্রোলাইট এনার্জি ড্রিংক মান দেয়ার মতো বিএসসিআইয়ের কাছে মান নেই। আগামী লিমিটেডসহ অন্যান্য এনার্জি ড্রিংকস কোম্পানি বাজারজাত করার আগেই বিএসটিআইয়ের কাছে আগেই গিয়েছে। কিন্তু তারা কোনো সুরাহা দিতে পারেনি। যদিও বিএসটি বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে সম্প্রতি এই এনার্জি ড্রিংকস নিয়ে নিরাপদ খাদ্য আদালত মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এই এনার্জি ড্রিংকসের মান দিতে বিএসটিআই গত কিছুদিন ধরে কাজ শুরু করেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনীমের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বিএটিবির পক্ষ থেকে বক্তব্যের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন চাওয়া হয়। লিখিত বক্তব্যে দেয়ার কথা থাকলেও পরে আর কোনো বক্তব্য জানানো হয়নি।
বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত সূত্রমতে, ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস এসএমসি প্লাসের অনুমোদন না থাকার কথা স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ওয়ালিউল ইসলাম। এজন্য বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত তাকে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন। ১৬ মে বৃহস্পতিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অবস্থিত আলাউল আকবরের আদালত তাকে এ জরিমানা করেন। সেই সঙ্গে ওয়ালিউল ইসলামের জামিন মঞ্জুরের আদেশ দেন। মামলার বাদী ও নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের পরিদর্শক কামরুল হাসান। অপরদিকে, ১৪ মে বাজারে বিক্রি হওয়া অনুমোদনহীন পাঁচটি কোম্পানির ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকসের মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের বিচারক আলাউল আকবরের আদালত। সেই সঙ্গে পাঁচটি কোম্পানির মালিকদের আগামী ৫, ৬ ও ৯ জুন আদালতে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑএসএমসি প্লাস, ব্রুভানা, অ্যাকটিভ, টারবো এবং রিচার্জ। এই পণ্যগুলো ওষুধ নাকি এনার্জি ড্রিংকসÑসে বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা দেয়ার কথা।