অনেক আশা দেখানোর বছর হতাশায় শেষ

আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজার বেশ কিছু দেখানো আশা নিয়ে চলতি বছরের যাত্রা শুরু করে। বছরের শুরুতে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল সূচক ডিএসইএক্স ৬ হাজার ৮৫৩ দশমিক ১৩ পয়েন্ট ছিল। কিন্তু বছর শেষে সূচকটি প্রায় ৫৫০ পয়েন্ট হারিয়েছে। সেই সঙ্গে বাকি সূচকগুলো পয়েন্ট হারানো ছাড়াও লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। অথচ বছরের শুরু থেকে বেশ কিছু আশার বাণী শুনে এসেছেন বিনিয়োগকারী ও বাজার-সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সরকারি বন্ডের লেনদেন চালু হলে বাজারের লেনদেন ৫ হাজার কোটি টাকা ছড়িয়ে যাবে। অচিরেই সূচক ৮ থেকে ১০ হাজার পয়েন্ট হবে এবং বাজার কারসাজি করে কেউ পার পাবে না ইত্যাদি। কিন্তু বছর শেষে কোনো আশাই পূরণ হয়নি। বরং বাজার হারিয়েছে সূচক ও লেনদেন, বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছে পুঁজি এবং কারসাজিকারী হয়েছে লাভবান। এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে শেয়ার বিজের ‘পুঁজিবাজার সালতামামি-২০২২’ প্রতিবেদনে। 

ডিএসইর সূচক ও লেনদেনের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বছরের শুরুতে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) ছিল ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্ট, যা বছরের শেষ দিন লেনদেন শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৬২০৬ দশমিক ৮১ পয়েন্টে। সে হিসাবে সূচকটি পয়েন্ট হারিয়েছে প্রায় ৫৫০ পয়েন্ট বা ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে ২০২২ সালে ডিএসইএক্স সূচক সর্বোচ্চ ৭১০৫ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনি¤œ ছিল ৫৯৮০ দশমিক ৫১ পয়েন্ট। এছাড়া অন্য

সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসই-৩০ ৩৩৭ দশমিক ২৮ বা ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং ডিএসইএস ৭২ দশমিক ২৯ পয়েন্ট বা ৫ শতাংশ হারিয়েছে।

এদিকে লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বছরজুড়ে লেনদেন হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্যে থাকলেও শেষ সময় এসে তলানিতে নেমেছে। এর মধ্যে চলতি বছরে ডিএসইতে এক দিন সর্বোচ্চ ৩২শ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। কিন্তু শেষের কার্যদিবসগুলোতে লেনদেন ২শ, ৩শ ও ৪শ কোটি টাকার ঘরে ঘুরেছে এবং সর্বশেষ দিন লেনদেন ছিল সাড়ে তিনশ কোটি টাকার কাছাকাছি। যেখানে বিএসইরি চেয়ারম্যান বিভিন্ন বেসরকারি এবং তালিকাভুক্ত সব ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন চালু হলে ডিএসইর লেনদেন এক দিনে ৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছিলেন। তবে সারা বছরের লেনদেন বিগত বছরগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

এদিকে গত বছর এবং চলতি বছরের পুরো সময়জুড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান যেসব আশার কথা বিনিয়োগকারীদের এবং বাজার-সংশ্লিষ্টদের শুনিয়েছেন সেগুলো ছিল:- ‘এ বাজারে ৫০০০ কোটি টাকা লেনদেন হবে, অচিরেই ইন্ডেক্স ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার হবে, কেউ ম্যানুপুলেশন করে পার পাবে না, বাজারে আর ২০১০-এর মতো বড় পতন হবে না, আপনাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা আমরা দেব। নিশ্চিন্তে বিনিয়োগে আসুন, মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ অনেক লাভজনক, বাংলাদেশে ইন্সুরেন্স সেক্টরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, অচিরেই সুইজারল্যান্ড থেকে একটা বড় বিনিয়োগ আসবে, দুবাই থেকে বড় বিনিয়োগ আসবে, ২০ হাজার কোটি টাকার স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন করা হবে এবং পুঁজিবাজারে শিগগিরই সুখবর আসবেসহ আরও বেশ কিছু আশার বাণী তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

কিন্তু বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, বছরজুড়ে কারসাজিকারীরা ছিল সক্রিয়। ফলে সূচক ওঠানামার মধ্যে থাকলেও লেনদেন ভালো হয়েছে। ফলে এ বছর তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। কিন্তু যারা কারসাজি করেছে তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া বাকিদের তেমন শাস্তি দিতে দেখা যায়নি। ফলে বছরজুড়েই ছিল আলোচিত দু-একটি নাম। এর মধ্যে একজন সমবায় অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের হিরো এবং তার সহযোগীরা। দেখা গেছে, বছরজুড়েই তারা কারসাজির কারণে জরিমানার শাস্তির আওতায় এসেছে। কিন্তু কারসাজি চক্রটি কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও জরিমানা হয়েছে নামমাত্র। ফলে বেশ কিছু কারসাজির সঙ্গে এখনও তারা যুক্ত আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। আর এ বিষয়ে ছিল বিএসইসির দায় সারা আচরণ।   

তবে বিএসইসির এ আচরণের মধ্যেও ছিল কিছু বাজার সংস্কারের কার্যক্রম, যা বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় ও উত্তম সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বাজারের জন্য যে উপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তার বিপরীতে ক্ষতিকর বিষয়ও ছিল বেশ কিছু এবং বাজারে কারসাজি চক্ররা জরিমানা দিয়েই পার পাওয়ায় আবার কারসাজি করার সুযোগ পেয়েছে। যে কারণে উপযোগী সিদ্ধান্তের ফলেও বাজার ঘুরে দাঁড়ায়নি বলে জানিয়েছেন তারা।

বছরজুড়ে বৈশ্বিক সংকটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পুঁজিবাজারকে সামাল দিতে চলতি বছর বিএসইসির নেয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হলোÑ চলতি বছরের মধ্যে বিএসইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলোÑফ্লো প্রাইস আরোপ। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে ধরাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারের দাম কমানো ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এ ধরনের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পুঁজিবাজারে না থাকলেও দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বহাল রাখা হয়েছে। পরে বিভিন্ন মহলের চাপে প্রথমে ব্লকে ফ্লোর প্রাইস থেকে ১০ শতাংশ কমে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয় বিএসইসি। কিন্তু এতেও কাজ না হওয়ায় মূল মার্কেটের ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটে এক দিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ কমার অনুমতি দিয়ে ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে দেয়া হয়।

এছাড়া আইপিওতে যারাই আবেদন করেন তারা সবাই শেয়ার পাওয়ার বিষয়টি চলতি বছর থেকে শুরু করা হয়। ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার গণনা শেয়ারের বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করার বিষয়টি অনুমোদন হয়। বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বেশ কিছু কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন ও অন্য কোম্পানির মাধ্যমে অধিগ্রহণের মাধ্যমে চালু করার উদ্যোগ নেয় হয় এবং বেশ কিছু কোম্পানিও কার্যক্রম শুরু করে। তবে এ বিষয়েও বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে বাজার-সংশ্লিষ্টদের মাঝে। এর মধ্যে একটি কোম্পানির পর্ষদে যুক্ত হতে হিরো-সহযোগীদের অনুমতি দেয়া বিষয়টি ছিল বড়। চলতি বছরে সময় সময়ে বেশ কিছু আইন-কানুন, বিধিবিধান সংস্কার করেছে বিএসইসি।

এছাড়া বছরজুড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু, জাপানে ভার্চুয়ালি রোড শো আয়োজন, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পুরস্কার-২০২২ প্রদান, বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ পুনর্বহাল রাখা, এসএমই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহজ করা, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনে সহায়তা, সিএসইর স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবিজিকে অনুমোদন, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট ফান্ড (ইটিএফ) ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠনে আইন প্রনয়ণ, বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) মাধ্যমে ফেরত প্রদান, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনার সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব বা ভীতি ছড়ানো কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ, শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করা ও বোনাস শেয়ার অনুমোদনের ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি।

বছরজুড়ে পুঁজিবাজারের অবস্থার সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাজার প্রথম দিকে ভালো অবস্থানে থাকলেও শেষের ছয় মাসে ভালো ছিল না। বিএসইসি থেকে সংস্কারের সঙ্গে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এর মধ্যে বড় ভুল হচ্ছে ফ্লোর প্রাইস দেয়া। বাজারের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ওঠানামা করা। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে যে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছে তা কোনো দেশেই নেই। এবং এ ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী বা কারও স্বার্থই রক্ষা হবে না। যে কারণে বর্তমানে শেয়ারগুলো অনেক বেশি দরে অবস্থানে করছে এবং কেউ বিনিয়োগ করছে না। ফলে লেনদেন কমে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বাজারে ইক্যুইটির চাহিদা বেশি। বন্ড থাকলেও বিনিয়োগকারীদের মূল আকর্ষণ ইক্যুইটিতে। বছরজুড়ে আইপিও এলেও ভালো কোনো কোম্পানির আসেনি। যে কারণে নতুন কোনো ইক্যুইটিতে সেরকম বিনিয়োগ হচ্ছে না। সারা বছর কিছু নির্ধারণ করা শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়েছে এবং সেগুলোতে বিনিয়োগ হয়েছে। যে কারণে শেয়ারগুলোর দর অনেক বেড়েছে। ফলে এখন শেষ সময় এসে অনেকেই মার্জিন ঋণ নিয়ে আটকে থাকলেও বের হতে পারছে না। যে কারণে মার্জিন ঋণের সুদ বাড়ছে কিন্তু ইক্যুইটি কমছে।