রহমত রহমান: সুতা অপচয় হিসেবে দেখানোর কথা ১৬ শতাংশ, অথচ দেখানো হয়েছে ৩৮ থেকে ৪২ শতাংশ। অতিরিক্ত অপচয় দেখিয়ে বন্ডকে সুতার নয়-ছয় হিসাব বুঝাতে চেয়েছে। আদতে অতিরিক্ত অপচয় দেখানোর নামে সুতা হাওয়া করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠান। মূলত শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অপচয় দেখানো প্রায় পৌনে ২২ লাখ কেজি সুতা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে ‘এপিএস ডিজাইন ওয়ার্কস লিমিটেড’, যাতে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। বন্ড সুবিধার সুতা অবৈধভাবে অপসারণ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড দিয়েছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার প্রতিষ্ঠান এপিএস ডিজাইন ওয়ার্কস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরের নিরীক্ষা মেয়াদের আমদানি-রপ্তানি-সংক্রান্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করেন কমিশনারেটের কর্মকর্তারা, যাতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এ তিন বছরে তিনটি ইউডির আওতায় ৭৫ লাখ ৬১ হাজার ৭৩০ কেজি সুতা আমদানি করেছে, যার বিপরীতে ৫২ লাখ ৮৩ হাজার ৯৬ কেজি সুতা ব্যবহার করে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করেছে।
ইউডি অনুযায়ী, ২০১৭ সালে আমদানি করা সুতার পরিমাণ ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৭১২ কেজি, যা দিয়ে তৈরি করা অনুমোদিত পোশাকের পরিমাণ ৫৭ লাখ ৮৬ হাজার ৭১৭ পিস। রপ্তানি করা পোশাকের পরিমাণ ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪৬ পিস। শিপিং বিল অনুযায়ী রপ্তানি করা পোশাকের পরিমাণ আট লাখ ৭২ হাজার ৪২৫ কেজি। প্রতিষ্ঠানের দলিলাদি অনুযায়ী, অপচয়ের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৮ সালের আদেশ অনুযায়ী, রপ্তানির জন্য সুতা থেকে পোশাক তৈরিতে কাঁচামালের সর্বোচ্চ অপচয়ের পরিমাণ ১৬ শতাংশ। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান এই চালানে অপচয় দেখাতে পারবে ১০ লাখ ১২ হাজার ১৩ কেজি। প্রতিষ্ঠানের কাছে চার লাখ ২৩ হাজার ৬৯৯ কেজি সুতা মজুত থাকার কথা। কিন্তু বন্ড কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে সুতার মজুত পাননি। প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে এই সুতা অপসারণ করেছে।
অপরদিকে ২০১৭ সালের অপর ইউডি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান সুতা আমদানি করেছে ১৯ লাখ ৬৮ হাজার ২৪৪ কেজি, যাতে অনুমোদিত পোশাকের পরিমাণ ৮৯ লাখ ২৫ হাজার ২০০ পিস। কিন্তু রপ্তানি করা হয়েছে ৮৯ লাখ ২১ হাজার ২৮১ পিস। শিপিং বিল অনুযায়ী রপ্তানি করা হয়েছে ১১
লাখ ৯৬ হাজার ১৫৯ কেজি। সুতার পার্থক্য রয়েছে সাত লাখ ৭২ হাজার ৮৫ কেজি। অপচয় দেখানো হয়েছে ৩৯ দশমিক ২২ শতাংশ। কিন্তু ১৬ শতাংশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান অপচয় সুবিধা পাবে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৪ কেজি। প্রতিষ্ঠানের কাছে মজুদ থাকার কথা পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ৭০০ কেজি সুতা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে এই সুতা মজুত নেই।
একইভাবে ২০১৮ সালের এক ইউডি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান সুতা আমদানি করেছে ২০ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৯ কেজি, যাতে অনুমোদিত পোশাকের পরিমাণ ৭৫ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৪ পিস। কিন্তু রপ্তানি করা হয়েছে ৭৫ লাখ ৭৬ হাজার ৭০৫ পিস। শিপিং বিল অনুযায়ী রপ্তানি করা হয়েছে ১১ লাখ ৯১ হাজার ৭১৩ কেজি। সুতার পার্থক্য রয়েছে আট লাখ ৭১ হাজার ৪৬৬ কেজি। অপচয় দেখানো হয়েছে ৪২ দশমিক ২৪ শতাংশ। কিন্তু ১৬ শতাংশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান অপচয় সুবিধা পাবে ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৮৭ কেজি। প্রতিষ্ঠানের কাছে মজুত থাকার কথা ছয় লাখ ৮০ হাজার ৭৯২ কেজি সুতা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে এই সুতা মজুত নেই।
অপরদিকে ২০১৮ সালের অপর ইউডি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান সুতা আমদানি করেছে ২০ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯৫ কেজি, যাতে অনুমোদিত পোশাকের পরিমাণ ৮৭ লাখ ৩৭ হাজার ২২০ পিস। কিন্তু রপ্তানি করা হয়েছে ৮৭ লাখ ২৫ হাজার ৯৪১ পিস। শিপিং বিল অনুযায়ী রপ্তানি করা হয়েছে ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৭ কেজি। সুতার পার্থক্য রয়েছে আট লাখ ৪৯৮ কেজি। অপচয় দেখানো হয়েছে ৩৮ দশমিক ২২ শতাংশ। কিন্তু ১৬ শতাংশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান অপচয় সুবিধা পাবে ১৫ লাখ এক হাজার ১৫২ কেজি। প্রতিষ্ঠানের কাছে মজুত থাকার কথা পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪৩ কেজি সুতা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে এই সুতা মজুত নেই। অর্থাৎ তিন বছরে প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ২২ লাখ ৭৮ হাজার ৬৩৪ কেজি সুতা মজুত থাকার কথা। কিন্তু এই সুতা বন্ড কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানের বন্ড গুদামে পাওয়া যায়নি। এ সুতা প্রতিষ্ঠান অপচয় সুবিধার অজুহাত দেখিয়ে অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অপসারিত এ সুতার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১৭ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৯৬৭ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর সাত কোটি ৯৩ হাজার ৫৯৩ টাকা। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ বিষয়ে ব্যাখ্যা ও দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে বন্ড কমিশনারেট। জবাবে প্রতিষ্ঠান জানায়, বর্তমানে বায়ারের চাহিদা অনুযায়ী নিত্যনতুন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাক উৎপাদন এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে অপচয়ের হার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় নব্বই দশকের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত অপচয় হার ১৬ শতাংশের ভেতরে রাখা অসম্ভব। শুনানিতে বন্ড কর্মকর্তা বলেন, ডিজাইনের কারণে অপচয় হার বেড়েছে। তবে অপচয় করা কাপড় বা সুতা কী করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
সূত্র আরও জানায়, মামলার নথি, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের জবাব এবং দলিলাদি পর্যালোচনা করা হয়। এতে অপচয়ের আড়ালে সুতা অবৈধভাবে অপসারণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে বিচারাদেশ দেয় কমিশনার। অর্থদণ্ডসহ প্রযোজ্য সাত কোটি ২০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৯৩ টাকার শুল্ককর পরিশোধ করতে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে এপিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসিব উদ্দিনের ব্যক্তিগত নম্বরে কয়েক দিন ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে হোয়াসঅ্যাপ নম্বরে দেয়া হলে তিনি সিন করেন। তবে কোনো জবাব দেন।
উল্লেখ্য, এপিএস গ্রুপের এপিএস ডিজাইন ওয়ার্কস লিমিটেড ছাড়াও এপিএস অ্যাপারেলস লিমিটেড, এপিএস অ্যাপারেলস ডায়িং লিমিটেড, এপিএস ক্লথিং লিমিটেড, এপিএস হোল্ডিংস লিমিটেড এবং এপিএস পেপার ওয়ার্কস লিমিটেড নামে সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।