অপরাধ প্রমাণের আগ পর্যন্ত কেউ অপরাধী নয়

মো. জিল্লুর রহমান: একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, অর্থ আত্মসাৎ, মাদক পাচার, যৌতুক দাবি, এসিড নিক্ষেপ বা এ ধরনের যত বড় ফৌজদারি অপরাধই করুক না কেন, আদালত কর্তৃক তার অপরাধ প্রমাণের আগ পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যায় না। ভয়ংকর দুর্ধর্ষ অপরাধী বা বড় সন্ত্রাসী হলেও তাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির আওয়ায় আনা উচিত এবং তারপর তাকে অপরাধী বলা উচিত, অন্যথায় দেশে-বিদেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায়, খুব আলোচিত কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম, বয়স, বাবার নাম, এমনকি বিস্তারিত ঠিকানাসহ বাড়ির ছবি পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এছাড়া খুনি, ধর্ষক, ডাকাত বা ছিনতাইকারী শব্দগুলো লিখে প্রায়ই গ্রেপ্তার ব্যক্তির গলায় ঝুলিয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গণমাধ্যম অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যাতে বিচারের আগেই অভিযুক্তরা জনমনে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়, যা কোনোভাবেই কাম্য ও আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটা অভিযুক্তদের ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।

২০১২ সালে একজন বিচারক ফেনসিডিলসহ আটকের পর হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোনো ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটি মানা হচ্ছে না। এছাড়া ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে স্থায়ী জামিনের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছিলেন, আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে থাকাবস্থায় দায়িত্বশীল পদে থেকে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছে বলে গণমাধ্যমে পুলিশ সুপার যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা শুধু অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষতই নয়, ন্যায়-নীতির পরিপন্থি। যেহেতু তদন্তকাজ চলমান, সেহেতু আদালত এই মুহূর্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকছে। তবে পুলিশ পরিদর্শককে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। তদন্ত চলার সময়ে পুলিশ সুপারের এ ধরনের বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। এটা কাম্য নয়। আদালত আশা করে, দায়িত্বশীল পদে থেকে পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবেন। আদালত এ মামলার তদন্ত চলার সময়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকছে। কিন্তু পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।

পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছিলেন, ইদানীং দেখা যায়, অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে এসে গণমাধ্যমে হাজির করে সংবাদ সম্মেলন করে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে মামলার তদন্ত নিয়ে উৎসাহী বক্তব্য দিতে দেখা যায়। গণমাধ্যমে হাজির করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বিচারে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু প্রচার করা যাবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা থাকা দরকার। নীতিমালা যাতে প্রণয়ন করা হয়, সেজন্য স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের আইজিকে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন হাইকোর্ট।

অথচ সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এবং যাদের সবচেয়ে বেশি আইন মেনে চলা প্রয়োজন, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই আইনের প্রতি সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করেই গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের গণমাধ্যমের সামনে শুধু হাজিরই করছেন না, বরং তাদের অপরাধের বর্ণনা দিয়ে সমাজে এই আটককৃত ব্যক্তিদের অপরাধী হিসেবেই পরিচিত করাচ্ছেন। গণমাধ্যম ছাড়াও তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ আটককৃত ব্যক্তির ছবি ও অপরাধের বিবরণ প্রচার করা হচ্ছে। অথচ আটককৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালতে প্রমাণিত হলেই কেবল ওই ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা যাবে।

আমাদের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে, সব নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমানভাবে বিবেচনা করা হবে। একই অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৯৪৮ সালের ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’-এর ৭নং অনুচ্ছেদে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। একটি দেশে তখনই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হয়ে সমান সুযোগ এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ভোগ করতে পারে।

সমাজে বসবাস করতে গিয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নানা জটিলতায় বিরোধের সৃষ্টি হয়। মানুষ পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক প্রথা, সম্পত্তিগত বিরোধ, মাদকাসক্তি, অর্থ আত্মসাৎ, সাইবার অপরাধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, এসিড অপরাধ, ধর্ষণ, পরকীয়া, মানব পাচারসহ নানা কারণে সামাজিক অপরাধে প্রবৃত্ত হয়। প্রয়োজন হয় আইনের আশ্রয় নেয়ার। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতা এবং পারিপার্শ্বিক অসহায়ত্বের কারণে মানুষ অনেক সময় আইনের আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি আর্থিকভাবে অসচ্ছল বা পারিপার্শ্বিক অসহায়ত্বের কারণে অসমর্থ হয়, তবে তাকেও আইনি সহায়তা দিতে হবে এবং অপরাধ প্রমাণের আগে তাকে অপরাধী বলা যাবে না।

বাংলাদেশে স্পর্শকাতর বিভিন্ন ঘটনায় সন্দেহভাজনদের আটকের পরপরই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করানোর বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বারবার প্রশ্ন তুলছেন। এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে তারা বলেছেন, হাইকোর্টেরও নির্দেশনা রয়েছে গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোনো ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়। কিন্তু অনেক আগে থেকেই স্পর্শকাতর অনেক মামলাতেই সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করা হলে তাদের ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করার সংস্কৃতি চালু রয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এক্ষেত্রে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, আমাদের দেশের অনেক ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াও একইভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উপস্থাপন করে, নানাভাবে ট্রল করে, যা ভুক্তভোগী ব্যক্তির জন্য চরম অবমাননাকর, সামাজিক সম্মানের জন্য বেশ বিব্রতকর এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য এটা তাদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ ও ক্ষতের সৃষ্টি করে, যা অপূরণীয় ক্ষতি এবং কোটি টাকায়ও পূরণীয় নয়।

গ্রেপ্তারের পরে যদি সন্দেহভাজনদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তবে সেটি তাদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে। আসলে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন মিডিয়া ট্রায়ালের নামে তাকে অপদস্ত বা সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন, সস্তা জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্যে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের প্রচারের জন্য সন্দেহভাজন মানুষদের এভাবে উপস্থাপন করে থাকে। অথচ তাদের অভিযুক্ত হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়, তারা আইনের দৃষ্টিতে কেউই অপরাধী নয়।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই কাউকে অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে না। কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। এটি তার আইনি সুরক্ষা ও মানবাধিকার। সেটি সে করতে পারে যখন বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই গ্রেপ্তার ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা বাংলাদেশের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথাকথিত মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে বিচারের আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জনমনে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া মিডিয়া ট্রায়ালের সময় দেখা যায়, আগেই তাদের দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন রকম ট্যাগ লাগানো হয়। কিন্তু সেসময় তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে না, কারণ বিচার শুরু হয়নি। তাই তাদের তখন কিছু বলারও সুযোগ থাকে না।

দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে, কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বা সন্দেহের কারণে বা প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে এনে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বা বিনা কারণেই ওই ব্যক্তির ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও চালানো হয়। অনেক উচ্চশিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গেই তুই-তোকারি করে কথা বলা, গালাগাল করে চড়, লাথি এমনকি লাঠি দিয়েও আঘাত করা হয়। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অনেক উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ যোগ দিলেও তাদের পূর্বসূরিদের দেখানো সেই ঔপনিবেশিক আদর্শের পথেই তারা চলছে। আটককৃত ব্যক্তি যতই শিক্ষিত, মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন হোক না কেন, তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান দেখানো হয় না, বরং তাদের সঙ্গে অত্যন্ত অমানবিক ও অভদ্র আচরণ করা হয়ে থাকে। অথচ চিহ্নিত সন্ত্রাসী, দাগী অপরাধী বা গডফাদারদের সঙ্গে এই বাহিনীর অনেক সদস্যেরই সখ্য দেখা যায়। আটক হলেও তাদের সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহারই করা হয়। অনেক সময় অদৃশ্য কারণে অনেক বড় অপরাধীকেও ছেড়ে দিতে দেখা যায়। এছাড়া যেসব কর্মকর্তার দ্বারা নির্দোষ ও নিরপরাধ ব্যক্তি অযথা হয়রানি হচ্ছে, অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে শিখিয়ে দেয়া স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে, বিচারের আগেই অপরাধী বানিয়ে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, সেসব দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সমাজে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অপরাধীকে নির্যাতন করে বা শাস্তি দিয়ে অপরাধ দমন করা যায় না। অপরাধী যাতে পরবর্তী সময়ে আর অপরাধ না করে, সেদিকেই খেয়াল রাখা জরুরি। তাছাড়া ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধ প্রমাণের আগে অপরাধী বলার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

ব্যাংকার ও  ফ্রিল্যান্স লেখক

rbbbp@gmail.com