Print Date & Time : 3 September 2025 Wednesday 11:49 am

অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়ে বায়ুদূষণ বাড়ছে

রোকাইয়া আক্তার তিথি: ক্রমাবনত দূষণের ফলে বিপর্যয়ে বাংলাদেশ। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে দূষণের মাত্রা। গত ২২ মার্চ রয়টার্স কর্তৃক প্রকাশিত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের দূষণের তথ্যভিত্তিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একটি দেশও ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) প্রত্যাশিত বায়ুমানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।

বাংলাদেশ আগের বছরের মতো ২০২১ সালেও সবচেয়ে দূষিত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী হিসেবে তালিকায় উঠে এসেছে। দেশে বায়ুদূষণ এখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বায়ুদূষণে আক্রান্ত সারাদেশ। প্রতিটি জেলাতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে বায়ুর মান তুলনামূলকভাবে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর।

একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরের বায়ুর মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এ সংস্থা গত ২৮ ফেব্রæয়ারি যে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) রেকর্ড করেছে, তার তথ্য মতে ঢাকার স্কোর ছিল ২৪২। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ এ স্কোর। ঢাকার পরেই ছিল যৌথভাবে কাজাখস্তানের নূর-সুলতান নগরী ও পাকিস্তানের লাহোর। এ দুই শহরের একিউআই স্কোর ওইদিন ছিল ১৮৭। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। এর ওপরে গেলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা মানুষের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

দেশের ৬৪ জেলার বায়র মান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গাজীপুর জেলার বাতাস সবচেয়ে দূষিত। স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর গবেষণায় জানা গেছে এ তথ্য।

গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সর্বমোট ৩১৬৩টি স্থানের গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২.৪১ মাইক্রোগ্রাম। দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় ১.৫৭ গুণ বেশি এটি।

পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশিদূষণ পরিলক্ষিত হয়। গাজীপুরের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ২৬৩.৫১ মাইক্রোগ্রাম।

গাজীপুরের পরেই রয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলা ঢাকা (দ্বিতীয়) ও নারায়ণগঞ্জ (তৃতীয়)। ঢাকার বায়ুতে বস্তুকণা ছিল ২৫২.৯৩ মাইক্রোগ্রাম। নারায়ণগঞ্জের বায়ুতে ছিল ২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম। উল্লেখিত সবচেয়ে দূষিত তিনটি শহরের বায়ুতে বস্তুকণার পরিমাণ বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ।

বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদীদূষণ, পরিবেশ দূষণ, আর্সেনিকদূষণ, পানিদূষণ প্রভৃতি। ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে চরম পর্যায়ে।

পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে বায়ুর পরেই রয়েছে পানিদূষণ। পানিদূষণের ক্ষেত্রে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদী অন্যতম উদাহরণ। যে নদীতে বর্জ্যসহ সব কিছুই নির্গমন করা হয়, ফলে বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধে তার পাশে টিকা দায় হয়ে যায়। ঢাকা ওয়াসা বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি পরিশোধন করে ঢাকাবাসীকে সরবরাহ করে। যে পানিকে বিশুদ্ধ করে পান করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় নলক‚পের পানিতে আর্সেনিকের আশঙ্কা রয়েছে।

ইউএনইপির ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, বেøজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ বাংলাদেশের ঢাকা ও চতুর্থ রাজশাহী! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সারাদেশে ২০ শতাংশ মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত। এই ২০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশই শিশু। যারা ট্রাফিক পুলিশ, রাস্তায় ডিউটি করেন, তাদের ১১ শতাংশের শ্রবণ সমস্যা আছে। আরেক রিপোর্টে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৬১ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের জন্য হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। শব্দদূষণের কারণে এখন ২০ শতাংশ মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত। শব্দদূষণ পরিস্থিতি যদি অপরিবর্তিত ও অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাহলে তো দেশের ১০০ শতাংশ মানুষেরই বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। শব্দদূষণ প্রতিরোধে শুধু সামাজিক সচেতনতা নয়, কঠোর আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

প্লাস্টিকের অতিমাত্রায় ব্যবহার দেশের পরিবেশদূষণের সহায়ক। উন্নত দেশ গুলো পুনঃব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, ফলে সেখানে দূষণের মাত্রা কম। কিন্তু বাংলাদেশ এ এমন নয়। প্লাস্টিক পচে না বা গলে যায় না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, মাটির উর্বরা শক্তি কমায়, খাল বা নদীর তলদেশে জমা হয়ে মারাত্মক ধরনের দূষণ সৃষ্টি করে। সভ্যতার অবদান প্লাস্টিক আমাদের দেশে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দিন দিন বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে। পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য যেখানে সেখানে নিষ্কাশন, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, অধিক পরিমাণ কীটনাশকের ব্যবহার, বনভ‚মি উজাড় করা, বৃক্ষরোপণ না করা, ওজোন স্তরের ক্ষয়, পেট্রোল ডিজেল গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহার, প্লাস্টিকের উৎপাদন ও নির্বিচারে ব্যবহার করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

প্রতিনিয়ত দূষণের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানবদেহে রোগ সংক্রমণ। দূষণের ফলস্বরূপ ক্যানসার, শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ (যেমন ব্রংকাইটিস, এলার্জি, হাপানি), চর্মরোগ সংক্রান্ত, কার্ডিওভাসকুলার, বাচ্চাদের বিকাশে ব্যাধি ও স্নায়বিক ক্ষতি, শব্দদূষণের ফলে বধিরতা, জেনেটিক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও কঠিন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবেশদূষণের ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি, পোলার ক্যাপগুলো গলে যাওয়া বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা, গ্রিন হাউস গ্যাসের সৃষ্টি, গেøাবাল ওয়ার্মিংসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে হচ্ছে।

অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইট হিসেবে স্যান্ড বøকের প্রচলন বাড়াতে হবে; ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বেশি পরিমাণ গাছ লাগানো এবং ছাদ বাগান করতে উৎসাহিত করা, সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে।

প্রস্তাবিত নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রæত সম্ভব বাস্তবায়ন করা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, বায়ুদূষণের পূর্বাভাস দেয়ার প্রচলন করা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। শিল্পবর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অধিক পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করা। উচ্চশব্দযুক্ত হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। কীটনাশকের মাত্রা কমানো। সর্বোপরি প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তি সচেতনতা পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর করা। এখন থেকে ব্যক্তি সচেতনতা সৃষ্টি ও যথাযথ প্রয়োগ না ঘটলেই অচিরেই মানব জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে। তাই, প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূষণ রোধে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করা।

বাগমারা, রাজশাহী