রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহে যানজটের সমস্যা বেশ পুরোনো হলেও তা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। নগরবাসীর ভাষ্য, আগের তুলনায় এখন যানজট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা বলছেন, ৫ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগে আধঘণ্টা, যা এখন আমাদের নিত্যদিনের ভোগান্তি।
মহানগরের নতুন বাজার মোড় এলাকায় চারদিকের সড়কে অসংখ্য ইজিবাইক আর রিকশা আটকে তীব্র যানজট হয়। এ দৃশ্য এখন প্রতিনিয়ত দেখা যায় চরপাড়া, গাঙ্গিনারপাড়, নতুন বাজার, জিলা স্কুল মোড়, ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড, ধোপাখলা মোড়, আলিয়া মাদরাসা মোড়, বাতিরকল মোড়, ফুলবাড়ীয় পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড, টাউনহল মোড় সিএনজি-পালকি স্ট্যান্ড ও স্টেশন রোডে। সকালে টাউন হল মোড় থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত সড়ক আর ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে চরপাড়া মোড় পর্যন্ত সড়ক দুটি প্রায় স্থবির হয়ে থাকে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তীব্র যানজট লেগে থাকে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগসহ নাগরিক সমাজের নেতারা মনে করেন, অপ্রশস্ত সড়ক ও অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশাই যানজটের প্রধান কারণ।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলেন, নগরীর ভেতরে বেশ কয়েকটি ছোটবড় সিএনজি-মাহিন্দ্র স্ট্যান্ড ও বাসস্ট্যান্ড রয়েছে, যার কারণে যানজটের ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করে। এছাড়া ছোটবড় মূল সড়কে অতিরিক্ত ইজিবাইক ও রিকশার কারণে তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে নগরের বিভিন্ন সড়কে দেখা যাচ্ছে ইজিবাইক, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। তবে অনেক ইজিবাইক একজন কি দুজনের বেশি যাত্রীও পাচ্ছে না। অথচ একটি ইজিবাইকে সাত থেকে আটজন যাত্রী বসতে পারে। সিটি করপোরেশনের উচিত, এসব ইজিবাইক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা।
মোটরবাইক চালক ফরহাদ হোসেন বলেন, দ্রুতগতির ইজিবাইক ও রিকশার কারণে প্রতিদিন যানজটে পড়তে হয়। প্রায়ই এ কারণে ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটে।
দাপুনিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে আসা ইজিবাইক চালক মানিক মিয়া বলেন, আগে অনেক কম অটোরিকশা ছিল। আমাদের ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হতো না, শহরের দিকে না এলেও চলতো। কিন্তু এখন কয়েকগুণ বেড়েছে অটোরিকশা কিন্তু ভাড়া তেমন পাই না, তাই বাধ্য হয়ে শহরে ঢুকি।
আরও বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরে বেড়েছে ইজিবাইক। শহরতলিতে থাকা কয়েকটি ইউনিয়নের ইজিবাইক ও রিকশা শহরে আসত না আগে, কিন্তু এখন এসব ইজিবাইক নিয়মিত নগরে চলাচল করছে। ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে অনুমতি পাওয়া ইজিবাইকগুলো জোড় ও বিজোড় সংখ্যায় ভাগ হয়ে এক দিন পরপর পালাক্রমে চলাচল করার নিয়ম। জোড় ও বিজোড় সংখ্যায় ভাগ করা ইজিবাইকগুলো লাল ও সবুজ রঙে চিহ্নিত। তবে এ ক্ষেত্রেও অনেক চালক নিয়ম না মেনে প্রতিদিন চালাচ্ছেন। আবার অনেকেই রাতারাতি ইজিবাইকের রং বদলে ভুয়া নম্বর ব্যবহার করে প্রতিদিন চলছে। এ কারণে নগরের বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট হচ্ছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বৈধ ইজিবাইকের সংখ্যা ছয় হাজার। আর রিকশার সংখ্যা ১০ হাজার। তবে প্রকৃত পক্ষে, বর্তমানে ১২ হাজার রিকশা, সাত হাজার অটোবাইক, কয়েকশ’ কার ও মাইক্রোবাস চলাচল করছে।
এ বিষয়ে মসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, যানজট নিরসনে সিটি মেয়র সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তরকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটি বেশ কয়েকটি সুপারিশও করেছে। সেই অনুযায়ী কাজও চলছে। আর অবৈধ ইজিবাইকের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে।
একদিকে অপ্রশস্ত সড়ক ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনিয়ন্ত্রিত রিকশা-অটোরিকশা, অন্যদিকে নগরীর ভেতর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত ট্রেন চলাচলের কারণে ছয়টি রেলক্রসিংয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকা থাকে বিভিন্ন যানবাহন। এসব লেভেল ক্রসিংয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে গড়ে ১০ মিনিট করে হলেও প্রতিদিন সর্বমোট ৯ ঘণ্টা লেভেল ক্রসিংয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
অপরদিকে ময়মনসিংহ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, কম্পিউটারাইজড ইন্টারলকিং সিস্টেমে প্রতিটি ট্রেন যাওয়ার সময় কমপক্ষে তিনটি লেভেল ক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার বন্ধ না করলে ট্রেনের লাইন ক্লিয়ার পাওয়া যায় না। সঙ্গত কারণে একটু আগে লেভেলক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা হয়।
এক সময় দিনের বেলায় শহরে ট্রাক প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এখন তা মানা হচ্ছে না। দিন ও রাতে অসংখ্য বালিবাহী ও পণ্যবাহী ট্রাক ধুলা উড়িয়ে দ্রুতবেগে হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ ও বায়ুদুষণ করে দাপিয়ে চলাচল করছে প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে। এছাড়া শহরের মাঝখানে নগরীর পুরোনো ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন শতাধিক বাস ও লেগুনা এবং দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটের বাস-ট্রাক প্রধান সড়ক জুবলিঘাট-থানাঘাট দিয়ে চলাচল করায় এসব সড়কে যানজট লেগে থাকে।
জেলা ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে জানান, গত ২০ বছরে যে পরিমাণ যানবাহন বেড়েছে সেই অনুযায়ী নগরীর একটি রাস্তাও প্রশস্ত করা হয়নি। আর দিনের বেলা বালিবাহী ও অন্যান্য পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলের বিষয়ে ডিসি, সিটি মেয়র ও অন্যান্য দপ্তরে সমন্বয়ে একটি মিটিং করার কথা ছিল যা কভিড-১৯-এর কারণে সম্ভব হয়নি। তবে আমরা শিগগির মিটিং করে যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারব বলে আশা করছি।
মসিক সূত্রে জানা গেছে, করপোরেশনের আয়তন ৯০ হাজার ১৭৩ বর্গকিলোমিটার। ৩৩টি ওয়ার্ডে মোট ২৯ হাজার ৭২৪টি হোল্ডিংয়ে প্রায় সোয়া আট লাখ লোক বাস করছেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের জাতীয় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এছাড়া শহরে মোট সড়কের পরিমাণ এক হাজার ৪৬০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা রাস্তা রয়েছে ৪৮৬.৭৮, কাঁচা সড়ক ৯৪৫.৩৬, এইচবিবি ৫.৪১ ও আরসিসি ২২.৪৫ কিলোমিটার।