মিশকাতুল ইসলাম মুমু : বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের একটি সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদকাসক্তি। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা পর্যন্ত আজ এই ভয়ংকর আসক্তির শিকার। শুধু শহরাঞ্চল নয়, মফস্বল এমনকি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাদকের বিস্তার চোখে পড়ার মতো। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এখনই প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ এবং জাতীয় ঐক্য।
মাদকাসক্তি ও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ আইন প্রণয়ন করা হয়। এর আওতায় মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, বিক্রি, সরবরাহ এবং ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মাদক ব্যবসা। দিনের পর দিন যেন মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। সাম্প্র্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে মাদকের সংস্পর্শে এসেছে। মাদকসেবীর মধ্যে ৮০ শতাংশই তরুণ। তাদের ৪০ শতাংশ আবার বেকার। এদের ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। শহরের বস্তি এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু-কিশোর মাদকাসক্ত। এছাড়া মাদকসেবীদের শতকরা ৬০ দশমিক ৭৮ ভাগই এসএসসি পাস করা। ২০ থেকে ৪০ বছরের মাদকসেবীর সংখ্যা শতকরা ৮১ দশমিক ৩৭ ভাগ। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মাদকের ভয়ংকর আগ্রাসনে কীভাবে তরুণ প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে তরুণদের মধ্যে বহুল প্রচলিত কিছু মাদকদ্রব্য হচ্ছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, স্পিরিট ইত্যাদি। মাদকদ্রব্য শুধু সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকেই আসছে না, বরং শহরের অভিজাত এলাকাগুলোর বিভিন্ন ক্লাবে, পার্টিতে এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশেও এগুলোর অবাধ ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।
সিনেমা, ওয়েব সিরিজ কিংবা ভিডিও কনটেন্টে মাদকসেবনকে ‘স্টাইলিশ’ বা ‘মুক্তিপথ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা তরুণদের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। এসব মাধ্যমে প্রচারিত ভুল ধারণা ও বিপজ্জনক বার্তা অনেক সময় মাদকাসক্তিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। সর্বোপরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নজরদারি ও সচেতনতার অভাবও তরুণদের এই ভয়ংকর পথের দিকে ঠেলে দেয়।
মাদকাসক্তির ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে মাদকসেবনের ফলে হৃদরোগ, লিভারের রোগ ও নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।
মাদকাসক্তির অন্যতম ভয়াবহ প্রভাব হলো মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন। মাদক গ্রহণের ফলে ব্যক্তির আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা থেকে বিচ্যুত হয়ে, তারা অবাস্তব আকাক্ষা ও ধ্রুবক মানসিক চাপের শিকার হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে অবসাদ, নিদ্রাহীনতা, আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও উদ্বেগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যা তাদের সামাজিক ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতন মনেও বিরূপ প্রভাব ফেলে, ফলে ক্রমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ফাটল দেখা দেয়। মাদকাসক্তির ফলে যুবসমাজের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও অপরাধমূলক পরিবেশে প্রবেশের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় তারা নিজস্ব জীবনের পাশাপাশি পুরো সমাজের নিরাপত্তাকেও হুমকিতে ফেলে। ঐশী রহমানের ঘটনা মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১৩ সালে সে নিজ বাসায় তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে খুন করে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াকালে খারাপ বন্ধুদের প্রভাবে ঐশী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আচরণে পরিবর্তন দেখে তার বাবা-মা তাকে সংশোধনের চেষ্টা করলে, ক্ষিপ্ত হয়ে ঐশী এ নৃশংস কাজ করে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, মাদকাসক্ত সন্তান কেবল নিজেকে নয়, পরিবারকেও ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
মাদকদ্রব্যের বিস্তার রোধ ও যুবসমাজকে এর ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন বহুমুখী ও সমন্বিত পদক্ষেপ। প্রথমত, পরিবারের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা বা অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো ও তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখলে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা। একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ সন্তানদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করে এবং তাদের বিপথে যাওয়া রোধ করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকবিরোধী সেমিনার, কর্মশালা ও মানসিক কাউন্সেলিং সেশন আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন, সে ব্যাপারেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। এর পাশাপাশি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ অপরিহার্য। সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচার বন্ধ করতে বিজিবি, কাস্টমস ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয়, সুশৃঙ্খল ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে মাদক চক্র, ডিলার ও আড়ত চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করতে হবে নির্ভয়ে ও ধারাবাহিকভাবে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে, কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মাদক সেবনের হারকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হলে সমাজের সব অংশীদারের সহযোগিতা ও সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন মানসম্মত ও সাশ্রয়ী পুনর্বাসন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়, মানসিক পুনর্বাসনের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে যুবসমাজের জন্য সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ামূলক কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। খেলাধুলা, সাহিত্যচর্চা, নাটক ও সংগীতের মাধ্যমে তরুণরা নিজেদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পায়, যা তাদের মানসিক চাপ কমাতে এবং সঠিক পথে রাখতে সহায়ক। মিডিয়াকেও এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সংবাদমাধ্যম, টিভি, সিনেমা ও সোশ্যাল মিডিয়াকে মাদকবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে এবং মাদকের গ্ল্যামারাইজেশন বন্ধ করতে হবে। সরকার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হবে একটি মাদকমুক্ত, সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলা।
নেশা কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি এক জাতীয় সংকট। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি সমাজের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরাও মাদকে আসক্ত। তরুণদের পাশাপাশি তরুণীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের নীল ছোবলে কোমল হাত পরিণত হচ্ছে ভয়ংকর খুনির হাতে। এই সংকট রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে এক অন্ধকার যুগ নেমে আসবে। তাই মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি সামাজিক বা আইনি উদ্যোগ নয়; এটি আমাদের জাতীয় ও মানবিক দায়িত্ব। আজকের তরুণরা যদি মাদকের জালে আটকে পড়ে, তবে আগামীদিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে কারা? এখনই সময় পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও মিডিয়া একযোগে কাজ করার। প্রতিটি যুবকের মধ্যে থাকা সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সচেতন, স্বাস্থ্যবান ও সৃজনশীল করে তোলা আমাদের সবার কর্তব্য। কঠোর আইন, দৃঢ় সামাজিক সচেতনতা এবং মানবিক সহানুভূতির সমন্বয়েই রুখে দেয়া সম্ভব এই নেশার থাবা। সত্যিকার অর্থে যুবসমাজকে শক্তিশালী করে তুলতে পারলেই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই সমাজ একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়