নিজস্ব প্রতিবেদক : সপ্তম দফার অবরোধে নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘দুর্জয়’ সাহস দেখতে চেয়েছেন বিএনপি মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল শনিবার তিনি বলেন, ‘আগামীকাল থেকে শুরু হবে আবারও নিরবচ্ছিন্ন ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি। গণতন্ত্র ফেরানো, আজকে অন্যায়ভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা, মানুষজনকে কারাবন্দি করা এবং তাদের মুক্ত করার যে কর্মসূচি, জনগণের মালিকানা ফেরত দেয়ার যে কর্মসূচিÑসেটা হচ্ছে এই অবরোধ কর্মসূচি। শান্তিপূর্ণ এই অবরোধ কর্মসূচিতে গণতন্ত্রমনা মানুষ, সাধারণ জনগণ এবং দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তারা দুর্জয় সাহস নিয়ে রাজপথে এগিয়ে যাবেÑএই প্রত্যয়, এই আশাবাদ আমি ব্যক্ত করছি।’ গতকাল বিকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
আজ রোববার ভোর ৬টা থেকে এই অবরোধ কর্মসূচি শুরু হবে, চলবে টানা মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত। সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে এটি হবে সপ্তম অবরোধ কর্মসূচি। রিজভী বলেন, ‘এই আন্দোলনে আপনি আমি-আমরা একা নই। আমাদের সকলের অংশগ্রহণে এক দফার আন্দোলন আরও বিস্তৃত, বেগবান ও তেজোদীপ্ত হবে। মনে রাখবেন দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ এবং বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিও আর বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন দেখতে চায় না, এদের পতন হবেই।’
‘বহু গ্রাম পুরুষশূন্য’
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর শীর্ষ নেতাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি আছেন, বাকিরা আছেন আত্মগোপনে। রিজভীও আত্মগোপনে থেকে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে জনগণ তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার পরবর্তী মেয়াদের জন্য কাদের হাতে অর্পণ করতে চায় তা সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের আলোকে নির্ধারণ করে দেয়। সেই নির্বাচনকে এখন হাসি-তামাশা, বাণিজ্য ও প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। জনগণের কাছ থেকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আর জনপ্রতিনিধিত্ব এখন শেখ হাসিনার দান-দক্ষিণা, খয়রাত, বিলিবণ্টন, ভাগ-বাটোয়ারা, উপহার-করুণায় পরিণত হয়েছে।’
আগামী ৭ জানুয়ারি যে সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটিকে ‘ভাঁওতাবাজির’ নির্বাচন বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘‘২০১৪ সালে ‘বিনা ভোটে অটোপাসের’ নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ‘নিশিরাতের ভোট ডাকাতির’ পর এবার আরেকটা ভাঁওতাবাজি নির্বাচন হবে। সেখানেও ওই আরেকটা সিলেকশন করা থাকবে, আগে যেটা প্রধানমন্ত্রীর বাসায় বা তার দপ্তরেÑসেটাও শুধু নির্বাচন কমিশন পাঠ করবে। ৭ জানুয়ারি ভোটের নামে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করা হবে অত্যন্ত নিখুঁত ধূর্ততায়, জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে। ইলেকশনের দিন রাত্রে পাঠ করা হবে গণভবনের তালিকা।’’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রিজভী বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে টার্গেট করে অর্থ এবং এমপি বানানোর প্রলোভনে কিংস পার্টি-ভুঁইফোড় পার্টিতে রাজনৈতিক নেতাদের ঢুকানো হচ্ছে। তবে কোনো নীতিবান, আদর্শবাদী, দেশপ্রেমী রাজনীতিককে তারা নিতে পারছে না। কিছু ডিগবাজিমার্কা-ভ্রষ্টচারী রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা বানাতে কাজ করেছে। টাকার বিনিময়ে খরিদ হওয়া এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এখনই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ তারা টাকা ও ক্ষমতার মুলোর লোভে পড়ে ডিগবাজি দেয়ার পর এখন বুঝতে পারছেনÑতাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না। পাতানো খেলার সাজানো নির্বাচনে হার হাইনেসÑযাকে যাকে চাইবেন, তারাই হবেন এমপি, তারাই হবেন ক্ষমতাশালী, অন্য কেউ না।’
নির্বাচন এলে আগে দেশজুড়ে আনন্দ-উৎসবের জোয়ার নামতÑউল্লেখ করে রিজভী বলেন, ‘‘এখন তার পরিবর্তে সারাদেশে ভয়ার্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। যারা আওয়ামী লীগ করে তারা ছাড়া সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, বহু গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। মনোনয়ন নিয়ে ইতোমধ্যে খুনোখুনি শুরু করেছে তারা (আওয়ামী লীগ)। নির্বাচনকে সরকার উৎসবের বদলে ভয়, আতঙ্ক ও শোকে পরিণত করেছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে নেতাদের বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে রাতের বাহিনী। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে নির্বাচনের পথে হাঁটছে ‘মাফিয়াচক্র’। তবে তুমুল আন্দোলনে-জনজোয়ারে এই নির্বাচনী নাটক ভণ্ডুল হয়ে যাবে।”
‘সাজা দেয়ার হিড়িক পড়েছে’
রিজভী বলেন, ‘‘এই প্রতারক মাফিয়া সরকার একদিকে বলছেÑ‘নির্বাচনে আসুন’, অন্যদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীসহ আন্দোলনে সক্রিয় ও সাহসী নেতাদের টার্গেট করে বেছে বেছে তাদেরই কারাদণ্ড দিচ্ছে। পুরোনো মামলায় সাজা দেয়ার হিড়িক শুরু হয়েছে। নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে দুই বছরের নিচে কারও সাজা হচ্ছে না। কারণ দুই বছরের সাজা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রতিবন্ধক। এসব কারাদণ্ড প্রদান করা হচ্ছে আজব আদালত থেকে, যেখানে মৃত নেতা, গুম হওয়া নেতাদেরও রেহাই নেই। মৃতদেরও সাজা দিচ্ছেন শেখ হাসিনার পুতুল আদালত। গত দেড় মাসে বিএনপির ৫৮২ জন নেতাকর্মীকে ‘প্রহসনের বিচারে’ দণ্ডিত ঘোষণা করা হয়েছে। আসামিদের অনুপস্থিতিতে চার্জ গঠন ও কারাগারে বন্দি অবস্থায় আসামিকে সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা শোনার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে সাজা ঘোষণা করা হচ্ছে।”
রিজভীর ভাষ্য, গত এক দিনে সারাদেশে বিএনপির ৩২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১৩টি মামলায় ১ হাজার ৪৩৫ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে ৪ হাজার দুইশর বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; ১৩৮টি মামলায় ১৬ হাজার ১২৫ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।