অবশেষে নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিন গ্রহণ করতে যাচ্ছে রেলওয়ে

ইসমাইল আলী: দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সরবরাহকৃত ১০ মিটারগেজ ইঞ্জিনে দরপত্র অনুযায়ী বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি। এজন্য প্রায় এক বছর ধরে আটকে আছে ইঞ্জিনগুলোর গ্রহণ প্রক্রিয়া। তবে সম্প্রতি কারিগরি কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। দায়সারা এ প্রতিবেদনে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে নি¤œমানের যন্ত্রাংশ সংযোজনের বিষয়গুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে যাচ্ছে রেলওয়ে।

ইঞ্জিনগুলো কেনায় ঋণ দিয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। গত জুনে এ ঋণের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে ঋণের মেয়াদ আর বাড়াতে রাজি নয় এডিবি। যদিও গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে ছয় মাস। এ হিসেবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে রেলওয়ের হাতে। তাই ইঞ্জিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমকে দ্রুত মূল্য পরিশোধের পাঁয়তারা শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা।

তথ্যমতে, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে রেলওয়ে। চুক্তিমূল্য ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলার বা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেয়া হয়। বাকি অর্থের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসার পর ৬৫ শতাংশ আর গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ পরিশোধের শর্ত ছিল। তবে নি¤œমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন প্রকল্পটির তৎকালীন পরিচালক নূর আহম্মদ হোসেন।

নিম্নমানের ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতিও জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ওই কমিটি। এতে হুন্দাই রোটেম ও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেক্টর সিঙ্গাপুরের সিসিআইসিকে অভিযুক্ত করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ইঞ্জিনগুলো তৈরিতে কারিগরি শর্ত অনুসরণ করা হয়নি। ইঞ্জিন, অলটারনেটর, কম্প্রেসর ও ট্রাকশন মোটর এ চারটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টস চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। ফলে টেস্ট রানের সময় ইঞ্জিনের ব্রেক হর্সপাওয়ার ২২০০বিপিএইচ ও ট্রাকশন হর্সপাওয়ার ২০০০টিএইচপি হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় যথাক্রমে ২১৭০বিপিএইচ ও ১৯৪২টিএইচপি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নমানের যন্ত্রাংশে তৈরি ইঞ্জিনগুলো চালানোর উপযুক্ত কিনাÑতা যাচাইয়ের জন্য ২৩ মার্চ কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়।

সম্প্রতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ওই কারিগরি কমিটি। এতে বলা হয়েছে, হুন্দাই রোটেমের সরবরাহকৃত ১০ ইঞ্জিন চালানোর উপযুক্ত। আর টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর মূলত মিটারগেজ রেলপথের জন্যই উপযুক্ত। তাই টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর দরকার নেই। বরং ডিজাইনের সময় তা ভুলবশত রাখা হয়েছিল। যদিও ইঞ্জিনের অন্যান্য যন্ত্রাংশ যে নিম্নমানের দেয়া হয়েছে, তা এড়িয়ে গেছে কারিগরি কমিটি।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ও রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) মো. বোরহান উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তদন্ত কমিটির অপর সদস্য ও প্রকল্পটির সাবেক পরিচালক আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যদিও এরই মধ্যে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে রেলওয়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, কারিগরি কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে লকডাউনের কারণে এ-সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কারিগরি কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, টিএ-৯ লোকোমোটিভ মিটারগেজ রেললাইনে চলার উপযুক্ত। এই ইঞ্জিন তো ব্রজগেজ লাইনে চলবে না। আর বিদ্যমান ডিজাইনে টিএ-১২ সংযোজনও সম্ভব নয়। এছাড়া চুক্তির সময় ভুলবশত টিএ-১২ লেখা হয়েছে। কোম্পানিটি সঠিকটাই দিয়েছে। যদিও ভুলবশত কাজটি হয়েছে। এখন তা সংশোধন করা সম্ভব নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের দিকে আগানো হচ্ছে।

হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনাÑজানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তথ্যমতে, নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তবে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ইঞ্জিনের মূল্য পরিশোধ করে প্রকল্পটি শেষ করার পাঁয়তারা চলছে।

এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ হাসান মনসুর বলেন, গত জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সেটি বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এডিবির ঋণেরও মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে এডিবি ঋণের মেয়াদ বাড়াতে রাজি নয়। যদিও গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ছয় মাস আছে। তাই ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

প্রসঙ্গত, গত বছর ৯ ডিসেম্বর ‘রেলওয়ের ১০ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম: নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম’ শীর্ষক প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় শেয়ার বিজে। পরে এ নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন শেয়ার বিজে প্রকাশিত হয়।