## একবার ইউজার আইডি দেওয়া হলে তা বন্ধ করা হয় না
## দুই কর্মকর্তার আইডিতে খালাস হয় প্রায় চার হাজার চালান
## চক্রের খোঁজে শুল্ক গোয়েন্দা
রহমত রহমান: রাজস্ব কর্মকর্তা ডিএএম মুহিবুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি তিনটি দফতর ঘুরে যশোর ভ্যাট থেকে ২০১৫ সালে অবসরে যান। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত অবস্থায় তিনি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড নেন। কিন্তু বদলি হওয়ার পর ২০১৮ পর্যন্ত আইডি সচল এবং ওই আইডি ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ চালান খালাস নেওয়া হয়েছে।
ফজলুল হক নামে আরেকজন কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার চালান খালাস নেওয়া হয়েছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এ আইডি ব্যবহার করা হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের মিথ্যা ঘোষণার স্থগিত করা চালান কীভাবে খালাস নেওয়া হয়েছে, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এ চমকপদ ও ভয়াবহ জালিয়াতি উদ্ঘাটন করেছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার গুলশান আরা সিটি এলাকার জারা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করছে বলে খবর পায় শুল্ক গোয়েন্দা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির একটি চালান স্থগিত করতে শুল্ক গোয়েন্দার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু হানিফ মোহাম্মদ আবদুল আহাদ চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারকে চিঠি দেন। শুল্ক জালিয়াতির সংবাদ থাকায় ২৫ জুন চালানটি স্থগিত করতে এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) কাস্টমসকে নির্দেশ দেয়।
চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে শুল্ক গোয়েন্দার নামের বিপরীতে পণ্য চালানটির বিএল লক করে দেয়। পরে আমদানিকারকের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিল অব এন্ট্রি দাখিল করলে কিছু সময়ের জন্য তা আনলক করে বিল অব এন্ট্রি দাখিলপূর্বক আবার লক করা হয়। দীর্ঘদিন হলেও আমদানিকারক চালানটি খালাস নেয়নি। পরে শুল্ক গোয়েন্দা গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর ও ৫ নভেম্বর চালানটি কায়িক পরীক্ষা এবং খালাস নিতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে চিঠি দেয়। আমদানিকারক খালাসে সাড়া দেয়নি। সন্দেহ হলে শুল্ক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানতে পারে, চালানটি বিশেষ কায়দায় খালাস হয়ে গেছে।
শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২৪ জুন বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে আবার লক করে দেওয়া হয়। এর তিন মাস পর ২৬ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টা ৫৮ মিনিটে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে রাজস্ব কর্মকর্তা মুহিবুল ইসলামের আইডি ব্যবহার করে অসাধু চক্রটির বিস্ময়কর জালিয়াতির মাধ্যমে চালানটি আনলক করা হয়। পরে বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে এক্সিট নোট ইস্যু করে চালানটি খালাস নেওয়া হয়, যা কাস্টম হাউজ বা শুল্ক গোয়েন্দা জানে না। চালান খালাস হয়ে গেলেও ২৭ সেপ্টেম্বর একই আইডি ব্যবহার করে সিস্টেমে চালানটি আবার লক করে দেওয়া হয়।
আইডিটি ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাজস্ব কর্মকর্তা ডিএএম মুহিবুল ইসলামের বিপরীতে এক্সপোর্ট-সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য ইস্যু করা হয়। জালিয়াতি উদ্ঘাটন করে শুল্ক গোয়েন্দা কাস্টম হাউজকে অবহিত করলে ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আইডিটি ব্লক করে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, মুহিবুল ইসলাম ২০১৫ সালে অবসরে যান। তবে চক্রটি এ কর্মকর্তার আইডি ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে ১১৬ বার ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য খালাস নিয়েছে, তার প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। একজন কর্মকর্তা বদলি এবং অবসরে যাওয়ার পরও তার আইডি ব্যবহার করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া পণ্য কীভাবে খালাস হচ্ছে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা।
একই বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে, ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত ফজলুল হক নামের আরেক রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি তিন হাজার ৬৮১ বার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ব্যবহার করে পণ্য খালাস নেওয়া হয়েছে। অথচ সেই কর্মকর্তা বহু আগেই বদলি হয়ে গেছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আইডিটি ব্যবহার হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা।
শুধু এ দুই রাজস্ব কর্মকর্তাই নন, আরও বহু কর্মকর্তা বদলি বা অবসরে যাওয়ার পরও তাদের আইডি ব্যবহার করে একই কায়দায় পণ্য খালাস নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছে শুল্ক গোয়েন্দা। বছরে কী পরিমাণ চালান বা কত কোটি টাকার পণ্য খালাস নেওয়া হয়েছে, তা উদ্ঘাটনে শুল্ক গোয়েন্দা কাজ করছে।
সূত্র জানায়, আইডি অপব্যবহার করা কয়েকটি চক্রকে প্রযুক্তির সহায়তায় শনাক্ত করার চেষ্টা করছে শুল্ক গোয়েন্দা। বহু কর্মকর্তা ও চক্রের হোতাকে নজরে রাখা হয়েছে। দ্রুত গ্রেফতারপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের মতো একটি সুরক্ষিত সিস্টেমের অপব্যবহার করে কাস্টমসের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করায় চক্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং আইডি বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে সুপারিশ প্রতিবেদন দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অনুসন্ধানে চমকপদ ও উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা আরও তদন্ত করছি। ব্যবস্থা নিতে আমরা এনবিআরকে সুপারিশ করেছি।’
কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে কাজ করার জন্য সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কমিশনার পর্যন্ত ইউডার আইডি-পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়। মূলত রাজস্ব কর্মকর্তারা এ সিস্টেমের সব কাজ করেন। এ আইডি বিভিন্ন ধরনের হয়। কেউ আছেন সিস্টেমে সব দেখতে পারবেন; কিন্তু কাজ করতে পারবেন না। আবার কেউ আছেন নোট করতে পারবেন কিন্তু কোনো অ্যামেন্ডমেন্ট করতে পারবেন না। কেউ কেউ সব দেখতে ও করতে পারবেন। এভাবে পদ অনুযায়ী আইডি দেওয়া থাকে। কাজ অনুযায়ী কর্মকর্তাদের আইডি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তা বদলি হলে তার বদলির আদেশ সব জায়গায় দেওয়া হয়। তখন প্রোগ্রামারও আদেশ পান। নিয়ম হলো, আদেশ পাওয়ার পর প্রোগ্রামার বদলি করা কর্মকর্তার আইডি লক করে দেবেন। কিন্তু লক না করলে সেটা হবে তার দায়িত্বে অবহেলা।
এ বিষয়ে কাস্টম হাউজ (আইসিডি) কমলাপুরের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কর্মকর্তা বদলি হলে আইডি লক করে দেওয়াই নিয়ম। আমি মাত্র তিন মাস হলো এখানে জয়েন করেছি। জয়েন করেই এ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। কর্মকর্তা বিদায় নেওয়ার আগেই লক করে আমাকে এখানে কনফার্ম করবেন। আমি জয়েন করার পর থেকে অপব্যবহারের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্ট্রংলি নির্দেশনা দিয়েছি যে, কেউ বদলি হয়ে গেলে আইডি লক করে দেবেন এবং লক করেছে কি না, সে বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স নিতে হবে। একটি ফরম তৈরি করার চিন্তা করছি। সে ফরমে কর্মকর্তা আবেদন করবেন। আবেদনে ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড উল্লেখ করে তা লক করতে আবেদন করবেন। লক করে সে আবেদন কর্মকর্তাকে দেওয়া হবে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, কাস্টমসে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি রোধে ১৯৯৪ সালে ঢাকা কাস্টম হাউজে অ্যাসাইকুডা ভার্সন-টু’র মাধ্যমে শুল্ক বিভাগ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির সূচনা হয়। উন্নততর প্রযুক্তির অংশ হিসেবে ২০০২ সালে কয়েকটি শুল্ক স্টেশনে অ্যাসাইকুডা প্লাস প্লাস চালু হয়। অত্যাধুনিক ভার্সন হিসেবে ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজসহ সব কাস্টম হাউজে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড চালু করা হয়। এ পদ্ধতিতে আমদানি-রফতানি দলিলাদি, শুল্ক মূল্যায়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করা হয়ে থাকে।
