অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না তদারকি সংস্থাগুলো 

মো. জিল্লুর রহমান: রাজধানী ঢাকার উত্তরার ব্যস্ততম সড়ক জসীমউদ্দীন রোডের মোড়ে বিপণিবিতান আড়ংয়ের সামনে একটি নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কংক্রিটের বিশাল গার্ডার ক্রেন দিয়ে তোলার সময় চলন্ত গাড়ির ওপর পড়ে মর্মান্তিকভাবে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর গার্ডারটি সরিয়ে মরদেহগুলো বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা। যারা নিহত হয়েছেন তাদের সবাই একই পরিবারের সদস্য বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। তারা একটি বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে ঢাকার কাওলা থেকে আশুলিয়ার দিকে যাওয়ার পথে গার্ডারটি ধসে পড়ে এবং এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নির্মাণাধীন প্রকল্পের গার্ডার পড়ে এ পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে নিহত হয়েছেন ২৩ জন এবং আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। রাজধানীর নিমতলী, চুড়িহাট্টা, কামালবাগসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ব্যবসার কারণে সৃষ্ট অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডে গত এক দশকে দুই শতাধিক মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। কয়েকশ মানুষ দগ্ধ ও গুরুতর আহত হয়েছেন। উত্তরার দুর্ঘটনার আগে ২০২১ সালের ১৪ মার্চ প্রথম বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার ধসে পড়ার ঘটনা ঘটে। একই দিনে দুবার বিমানবন্দর ও আব্দুল্লাপুরে দুটি গার্ডার ধসে পড়ে। এতে ছয়জন আহত হন। এখানে পথচারী ও প্রকল্পের নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন। এরপর গত ১৫ জুলাই গাজীপুর শহরে বিআরটির গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। সবশেষ গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের দিনে উত্তরায় ক্রেন থেকে প্রায় ৫০ টন ওজনের একটি গার্ডার সড়কে আছড়ে পড়ে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের ওপর। এতে ঘটনাস্থলে পাঁচজন নিহত এবং দুজন আহত হয়েছেন। এর আগে চট্টগ্রামের বন্দরহাট ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের সময় ২০১২ সালের ২৯ জুন প্রথম ১৩০ ফুটের কংক্রিটের গার্ডার নিচে পড়ে যায়। এরপর একই বছরের ২৪ নভেম্বর ওই ফ্লাইওভারের আরেকটি বিশালাকৃতির গার্ডার পড়ে ১৭ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় আরও অনেকে আহত হন। এসব ঘটনার তদন্ত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

মূলত সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের চরম গাফিলতিতে এ ধরনের একের পর এক বড় বড় অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটছে, দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের মিছিল। কিন্তু এতকিছুর পরও একরকম ‘নীরব দর্শকের ভূমিকায়’ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কেউ কোনো দায়দায়িত্ব স্বীকার করে না। এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সংশ্লিষ্টদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। গঠন করা হয় একের পর তদন্ত কমিটি। জমা পড়ে বস্তাবন্দি বিশদ প্রতিবেদন। চিহ্নিত হয় দুর্ঘটনার কারণ। কিন্তু অজানা কারণে এসব লোকদেখানো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। গণমাধ্যমেও কিছুদিন গরম গরম শিরোনামে সংবাদ পরিবেশিত হয়, কিন্তু কিছুদিন পর ঠিকই সব হাওয়ায় মিশে যায়। কেউ কারও খবর রাখে না। সমাধানে আসে নানা সুপারিশ। দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়, কিন্তু মামলায় গতি আসে না। বিচারও হয় লোকদেখানো নামকাওয়াস্তে। দায়ীদের যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না, অর্থাৎ এগুলোর যথাযথ তদারকি ও বাস্তবায়ন নেই। প্রকারান্তরে দায়ীরা অধরাই থেকে যাচ্ছে, হচ্ছে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল ও হতাহতের সংখ্যা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এগুলো নিছক কোনো মামুলি দুর্ঘটনা নয়, দায়িত্বে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৌশলগত হিসাব অনুযায়ী নির্মাণ প্রকল্পের গার্ডার ওঠানোর সময় ছুটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি ১০টি গার্ডার উত্তোলনের সময় একটি ছুটে যাওয়ার বিষয়কে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে নির্মাণকাজের সময় সে ধরনের নিরাপত্তা, সতর্কতা ও প্রস্তুতি রাখতে হয়। গার্ডার পড়ে হতাহতের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সে সময় তদন্ত হয়েছে, কিন্তু দায় চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এজন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ ঘটনার তদন্তের কারণ ও দায় চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

বাংলাদেশে আসলে কোনো অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় কখনও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হয়নি। অনেকে বলছেন, এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার মূল কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সাভারের রানা প্লাজা ধসে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণণœ হওয়ায় ভবন মালিক কারাগারে রয়েছেন। এক হাজার ১৩৮ পোশাকশ্রমিক মারা গেলেও ঘটনাটিতে এখনও কারও শাস্তি হয়নি। একটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে ১০টি ঘটনা বন্ধ করা যায়। বিচার না হলেও প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই কমিটির প্রতিবেদনে কী থাকে, সেটি আর সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। অথচ এ ধরনের ঘটনাগুলো নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, অবহেলাজনিত মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড।

এ ধরনের অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড থাকা উচিত। এটি এখনও নির্ধারিত হয়নি। ফলে মালিক শ্রম আইনে নির্ধারিত নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে পার পেয়ে যান। রানা প্লাজা ধসের পর ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে উচ্চ আদালত ভূমিকা রাখলেও পরে চূড়ান্ত রায় হয়নি। শিল্পকারখানার দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক-কর্মচারী মারা গেলে ক্ষতিপূরণ মাত্র আড়াই লাখ টাকা। অথচ ‘আইএলও কনভেনশন ১২১’ অনুসরণ করে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আজীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) পরিদর্শকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। তবে পোশাকের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সংস্থাটির পরিদর্শন কার্যক্রমকে সাজানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার বিপুল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে পরিদর্শনের যে সক্ষমতা বাড়িয়েছে, সেটি শুধু তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যবহƒত হবে তেমন একটি মানসিকতা তৈরি হয়েছে। তার ফলে পোশাকের বাইরেও যে শিল্পকারখানা রয়েছে এবং সেখানে দুর্ঘটনার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে, সেটি গ্রাহ্য করা হয়নি।

পুরান ঢাকায় প্রায় দুই হাজার অবৈধ কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সরকার পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয়ার নির্দেশনা প্রদান করে। এরপর এক দশকের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও কোনো কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তর হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৭৮ জন প্রাণ হারান। এরপর আবারও তোড়জোড় শুরু হয়। তদন্ত কমিটি হয়, প্রতিবেদনে নানা সুপারিশ করা হয়। এরই মধ্যে প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও পুরান ঢাকার অবস্থা সেই আগের মতোই রয়েছে। এ অবস্থায় ১৫ আগস্ট আবার পুরান ঢাকার কামালবাগে প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছয়জন নিহত হয়েছেন। এখন নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়েছে। চলছে তোড়জোড়।

আসলে পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদাম সরানোর জন্য এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব সৃষ্টি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো ট্র্যাজেডির পরও ওই এলাকার বাসিন্দারা রাসায়নিক গুদাম মেনে নিয়েই বসবাস করছেন। এটার মূল কারণ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অনীহা, অপারগতা ও অনিচ্ছা। সে কারণে এবং লোভের কারণে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যকে সঙ্গে নিয়েই বসবাসে অভ্যস্ত হচ্ছেন। নিমতলীর ঘটনার পর কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তদন্ত কমিটি ২১ দফা সুপারিশ করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রী পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নিতে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। এর পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর অর্থে সক্রিয় হয়নি। এ কারণে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত না করায় এই অবস্থা চলছেই। সব অনিয়ম এখন নিয়ম হয়ে গেছে। কোনো প্রতিকার মিলছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জুড়ে বসেছে।

অনেকেরই স্মরণে আছে, এ বছরের জুন মাসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও দেশ-বিদেশের সংবাদ শিরোনাম হয়। এ কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৫০ জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হন। দুর্ঘটনার পর জানা যায়, ওই ডিপোসহ সীতাকুণ্ডের শতাধিক কারখানা ও ডিপোর মতো স্থাপনাগুলো ছয় মাস আগেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বিশদ পরিদর্শন করেছিল দুটি তদন্ত দল। অথচ দুর্ঘটনার পর তদারককারী সংস্থা বিস্ফোরণ অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস প্রভৃতি সংস্থা দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছিল। এতবড় একটি আন্তর্জাতিক মানের কন্টেইনার ডিপো, অথচ কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। খুবই অবাক করার বিষয়। একই ঘটনা ঘটেছিল সাভারের রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন, ঢাকার চুরিহাট্টা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) অগ্নিকাণ্ডের পর। সংশ্লিষ্ট এসব সংস্থা কোনোভাবেই এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। এগুলো নিছক কোনো অগ্নিকাণ্ড নয়, এগুলো অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। আমরা আর এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত অবহেলাজনিত মৃত্যু দেখতে চাই না। তদারকি সংস্থাগুলোর অবহেলার কারণেই এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এজন্য এরাও এ দুর্ঘটনার জন্য সমানভাবে অভিযুক্ত ও দোষী। দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি।

উত্তরার গার্ডার দুর্ঘটনার পরও সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তদন্ত রিপোর্টও আসবে; কিন্তু কিছুদিন পর আর কেউই খবর রাখবে না। এভাবেই দোষীরা পার পেয়ে যায়। এ ঘটনায় তদন্তপূর্বক দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারকি সংস্থাগুলোকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। তবে রোধ করা যাবে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com