অবৈধ ইটভাটায় বিপর্যস্ত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

এ বি এম সিয়াম আহমেদ : আধুনিক সভ্যতা গড়ে ওঠার অন্যতম উপাদান হলো ইট। ইট আবিষ্কারের পরই ইট দিয়ে তৈরি বিভিন্ন স্থাপনাশৈলীর দেখা মিলতে শুরু করল, আবাসিক কাজে ব্যবহার হতে লাগল। বড় বড় দালান, ইমারত থেকে রাস্তাঘাট যাই হোক না কেন সব কিছুই তৈরি হয় ছোট ছোট ইট থেকে। আর এসব ইট তৈরি করা হয় ইটের ভাটায়। ক্রমবর্ধমান এই চাহিদার জোগান দিতে ইট প্রস্তুতকারকরা ইট তৈরিতে মানছে না কোনো নিয়ম-নীতি। দেশে বিভিন্ন আইন, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও অবৈধ ইটভাটার দৌরাত্ম্য কমছে না। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ বিলিয়ন ইট উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন-ই এশিয়াতে উৎপাদিত হয় যা মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশ। ইটের ৬৭ শতাংশ চীনে, ১৩ শতাংশ ভারতে এবং বাংলাদেশে প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ উৎপাদিত হয়। মোটা দাগে বলা যায়, ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার, যাতে বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ পিস ইট তৈরি হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩ দশমিক ৫ হাজার ইটের ভাটা অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে; বাকিগুলো অনুমোদনহীন অবৈধ। আর এসব অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ ইটভাটার কারণে বিপন্ন হয়ে উঠছে চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ। ইট তৈরিতে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাটি। বছরে প্রায় ১২ কোটি ৯৬ লাখ টন কৃষিজমির উর্বর মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করা হয়। মূলত কৃষিজমির উপরিভাগের অংশ কেটে নেয়ার কারণে অত্যাবশ্যকীয় জৈব উপাদানসহ মাটির পুষ্টি উৎপাদনের চরম ঘাটতি হচ্ছে। ফলে কৃষিজমির পরিমাণ যেমন কমছে একইসঙ্গে মাটির উর্বরতা শক্তিও নষ্ট হচ্ছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইট তৈরি হয়। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতি। এক্ষেত্রে ধোঁয়া নির্গমনের জন্য প্রায় ১২০ ফুট লম্বা চিমনি ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে দেশে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ইটভাটায় ইট উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে জিগজাগ, হাইব্রিড হাফম্যান ও টানেল পদ্ধতিতেও ইট উৎপাদিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে টানেল পদ্ধতি সবচেয়ে আধুনিক এবং অনেকটা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যদিও এ পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা খুবই কম। বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস দেশে ইট উৎপাদিত হয়; বাকি মাসগুলোয় ইট উৎপাদন কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ থাকে। শুষ্ক মৌসুমে একদিকে বায়ুমণ্ডলে ধুলাবালির প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে ইটভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলউ’র সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় ওঠে আসে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ ভাগ। এছাড়াও ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাঠ ও আমদানিকৃত নিম্নমানের কয়লা। এসব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বনডাই-অক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের মতো ক্ষতিকর উপাদান যা বাতাসকে যেমন দূষিত করে, তেমনি গাছপালা এবং ফসলের ক্ষতি করছে। এছাড়া ইটভাটার বর্জ্যে যে সালফার থাকে তা নদী বা জলাশয়কে দূষিত করে। এর ফলে আশেপাশের নদী থেকে মাছসহ সব ধরনের জলজপ্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

মাটির তৈরি ইটের ব্যবহার কমাতে সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০২৫ সালের মধ্যে মাটির তৈরি ইটের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এগুলো ছিল শুধু কাগজে-কলমে বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। মাটির তৈরি ইট বানানোর ফলে ক্রমাগত কৃষিজমির উর্বর মাটি যেমন নষ্ট হচ্ছে একইসঙ্গে ফসল উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাচ্ছে। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ তে উল্লেখ আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করলে প্রথমবারের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের জন্য ভাটা কর্তৃপক্ষকে ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। একইসঙ্গে অনুমোদন না নিয়ে ইটভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু আদতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইটভাটা পরিচালনায় যে আইন রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। মূলত প্রশাসনিক দুর্বলতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি যেভাবে তার উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে সে হিসাবে মাটি পুড়িয়ে ইট বানানো বন্ধ না করলে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ খাদ্যঘাটতিতে পড়বে। এজন্য মাটির তৈরি ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণে ইটভাটা মালিকদের উৎসাহিত করতে সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ ইডকল গ্রিন ব্রিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটার জন্য অর্থায়ন প্রদান করছে। মূলত বায়ুদূষণ, জনস্বাস্থ্য, কৃষিজমি ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে অবৈধ ইটভাটা বন্ধের বিকল্প নেই। এজন্য পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার বাড়ানো শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, বেসরকারি খাত ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।