Print Date & Time : 6 July 2025 Sunday 9:54 pm

অভিভাবকের ভুলে শিশু সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারে

বর্তমান সময়ে ফেসবুক থেকে আয়ের একটা বড় মাধ্যম ব্যক্তিগত ব্লগ ভিডিও, গৃহিণীর রান্না বা শিক্ষার্থীর পরীক্ষার প্রস্তুতি সবটা এখন সবাই ভাগাভাগি করে নেন সামাজিক মাধ্যমে আর তার থেকে আয় করে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ।

তবে সম্প্রতি সময়ে শুরু হয়েছে শিশুদের নিয়ে অদ্ভুত ব্লগ, শিশুদের পণ্য বানিয়ে তথাকথিত ভিউয়ের জন্য বানানো হচ্ছে ভিডিও। আধো বুলিতে সদ্য  কথা বলতে শেখা শিশুদের শেখানো হচ্ছে ছবি তোলার অঙ্গভঙ্গি, বানানো হচ্ছে শিশুর জন্য অনুপযোগী অশ্লীল নাচের ভিডিও।

মায়েদের মধ্যে শুরু হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কার বাচ্চা বেশি সুন্দর, কার বাচ্চা ক্যামেরার সামনে ভালো অঙ্গভঙ্গি করতে পারছে সেসবের বিচারেই যাচাই করা হচ্ছে শিশুদের মেধা।

আগেকার সময়ে মায়েরা এ বয়সী শিশুদের নতুন নতুন শব্দ শেখানোর পাশাপাশি ঘুমপাড়ানির ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন, প্রতিদিন ছড়া শুনতে শুনতে বাচ্চাদের মাথায়ও সেগুলো গেঁথে যেত, একটু বুঝতে শিখলেই তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো ছবি আঁকা রঙিন বই, বাচ্চারাও আগ্রহ নিয়ে রঙিন বই দেখতে দেখতে অনেক পশু, পাখির নাম শিখে নিত।

অথচ বর্তমান সময়ে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের মূল্যবান সময়গুলো চলে যাচ্ছে ক্যামেরার সামনে তোতাপাখির মতো পাকা পাকা বুলি আওড়াতেই। এতে যেমন তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্য দিকে শিশুটি খেলার মাঠের চেয়ে ফোন স্ক্রিনেই তার শৈশব আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে এবং পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার আগেই মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় শিশুদের নিয়ে বানানো ব্লগের জন্য অবুঝ শিশুটি সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারে, ঝুঁকিতে পড়তে পারে শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢালাওভাবে শিশুদের ছবি ও তথ্য শেয়ার করলে এর বিরূপ প্রভাব শিশুটির বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে পৃথক দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ শিশু একটি সাইবার অপরাধের শিকার। ৩৮ ও ২৬ শতাংশ যথাক্রমে দুটি ও তিনটি সাইবার অপরাধের শিকার।

সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ জেনিফার আলম বলেছেন, শিশুদের প্রতি বিকৃত রুচি পোষণ করে এমন পিডোফাইল বা শিশুদের যৌন নির্যাতনের ওপর অনেক ওয়েবসাইট আছে, ফোরাম আছে। সেসব স্থানে এসব ছবি, ব্যক্তিগত তথ্যসহ আপলোড হয়ে যেতে পারে।

মেয়ে শিশুদের জন্য তো এটা আরও ভয়ংকর। কারণ একজন নারী তিনি যে বয়সেরই  হোন না কেন, তাকে সমাজে এখনও ভোগের বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয়।

এসব প্ল্যাটফর্ম যারা ব্যবহার করেন তারা যে কোনো শ্রেণি-পেশার বা মানসিকতার হতে পারেন। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চেয়েও ফেসবুক আইডির সংখ্যা বেশি। এর কারণ বেশিরভাগ ব্যবহারকারী একের অধিক ফেইক আইডি ব্যবহার করেন, এবং এসব ভুয়া বা ফেইক আইডি থেকেই সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে।

ফেইক আইডি দ্বারা সংঘটিত অপরাধের সবটা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নজরদারিতে আনা প্রায় অসম্ভব।

আপনার সাময়িক বিনোদনের জন্য আপনার শিশু দীর্ঘমেয়াদি যে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেÑ

১. শিশু পর্নোগ্রাফিতে আপনার সন্তানের ছবি যুক্ত করা হয়ে যেতে পারে। এটা নিশ্চয়ই কোনো বাবা-মা জন্য সুখকর ব্যাপার নয়; ২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়লে পরিচিত-অপরিচিত সবাই আপনার শিশুকে চিনে ফেলতে পারে, এর থেকে ঘটতে পারে অপহরণের মতো ঘটনা, ইতোমধ্যে যা বাংলাদেশে ঘটে গেছে; ৩. আপনার শিশুর তথ্য ও ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্ন একটি আইডি বা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারে যে কেউ। ভবিষ্যতে সেই অ্যাকাউন্টধারীর সব অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য দায়ী করা হতে পারে আপনার সন্তানকে।

এসবের ফলে শিশুটি হয়রানির শিকার হতে পারে। এমনকি বড় হওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদে শিশুটি মানসিক চাপে ভুগতে পারে।

কারণ ইন্টারনেটে কিছু আপলোড হলে সেটা সরিয়ে ফেলার সক্ষমতা সাইবার ক্রাইম ইউনিটের থাকলেও অনেক সময় চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না।

তাই ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের সীমানা হওয়া উচিত নির্দিষ্ট। আর স্বল্প পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সব বিষয়ে খুব খোলামেলা না হওয়াই ভালো। ‘বাচ্চার ছবিই তো। সবার কাছে গেলে কী আর হবে!’এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।

বাংলাদেশে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি যুক্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের ছবি বা যেকোনো তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া, সেই সঙ্গে এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে আরও বেশি প্রচারণার ওপর জোর দেয়া উচিত।

আফসানা সাথী

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়