ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি)। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নে কাজ করছে অধিদপ্তরটি। ভোক্তাদের জন্য সেবা সহজীকরণে হটলাইনের পাশাপাশি ‘সিসিএমএস’ নামে একটি অ্যাপ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিআরপি। ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা-অধিকার দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি শেয়ার বিজের মুখোমুখি হন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নজরুল ইসলাম
শেয়ার বিজ: বিশ্ব ভোক্তা-অধিকার দিবস উপলক্ষে এবার অধিদপ্তরের আয়োজন কী?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: ভোক্তা অধিকার বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। ওই দিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি সেখানে ‘সিসিএমএস’ নামের অ্যাপ উদ্বোধন করবেন। ভোক্তারা এই অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। অভিযোগ নম্বর ও শুনানির তারিখও পেয়ে যাবেন। এছাড়া আমরা একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছি। ওই দিন এর মোড়ক উšে§াচন করা হবে। বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়েও দিবসটি উদ্যাপন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য হলোÑ‘নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী।’
শেয়ার বিজ: ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধ এবং পণ্য ও সেবার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে অধিদপ্তর কাজ করে থাকে। কিন্তু দেশব্যাপী ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের বিদ্যমান সক্ষমতা কি যথেষ্ট?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং বিভাগীয় পর্যায়ে আটটি ও প্রত্যেক জেলায় কার্যালয় রয়েছে। জেলা কার্যালয়ে একজন সহকারী পরিচালক (এডি) ও একজন কম্পিউটার অপারেটর আছেন। এই দুজন যখন অভিযানে যান, তখন অনেকে অভিযোগ তোলেন অফিস বন্ধ। কারণ আর তো কেউ তখন অফিসে থাকছেন না। একটি জেলায় ১০-১২টি উপজেলা থাকে, তাহলে বোঝেন কত জনবল দরকার। সত্যিকার অর্থে আমরা যে পরিমাণ কাজ করছি, সেই আলোকে আমাদের জনবল কাঠামো অপ্রতুল। অথচ আমাদের অভিযোগের পরিমাণ বেড়েছে। মানুষের প্রত্যাশাও বেড়েছে। জনবল কাঠামো বৃদ্ধির জন্য ৪৬৫ জন নতুন জনবল চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।
শেয়ার বিজ: ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয়। এ আইন কি ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: ২০০৯ সালের প্রেক্ষাপট আর ২০২৩ সালের প্রেক্ষাপটের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ২০০৭ সালের প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সালের আইন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ বছর চলে গেছে। জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী এটি যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সেই সময়ে কিন্তু ই-কমার্স ছিল না। এখন সেটি যুক্ত হয়েছে। ই-কমার্স নিয়ে হাজার-হাজার অভিযোগ এসেছে। ২০০৯ সালের আইন অনুযায়ী, কিন্তু সেসব নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। আইনটি বর্তমান
প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুগোপযোগী করার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। ১৬ বছর আগের দণ্ড তো এখন চলছে না, এখনকার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী দণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।
শেয়ার বিজ: দেশের ব্যবসায়ীরা বেশ প্রভাবশালী। এক্ষেত্রে অধিদপ্তর কতটা প্রভাবমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারছে?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: আমরা কিন্তু একটা আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে চলি। প্রভাবটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সমাজে সেসব থাকবে। আমরা আইন অনুযায়ী আমাদের কাজ করে থাকি। আমরা খুচরা বিক্রেতা থেকে উৎপাদনকারী কাউকেই ছাড়ছি না। তাদের ব্যত্যয়গুলো তুলে ধরেছি। আমরা সরকারের কাছে জানিয়েছি। আইনে আমাদের যতটুকু ক্ষমতা দেয়া আছে, আমরা সেই পর্যন্তই যেতে পারি। আইনের কাঠামোর বাইরে তো আমরা যেতে পারি না। প্রভাব বলয়ের চাপ আমি পাইনি। ভোক্তা অধিকারের বিষয়ে যেখানে প্রশ্ন উঠছে, আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম আমাদের অনেক সহযোগিতা করছে। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। কারণ আমাদের নিজস্ব কোনো সোর্স নেই। আমি ৯-১০ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি, সেই হিসেবে ব্যবসায়ীদের পালস আমি বুঝি। সেজন্য তারাও আমাদের সহযোগিতা করে। অভিযানে গেলে কখনও বাধা দেয় না। এখানে কোনো প্রভাব নেই, বরং সহযোগিতাই পাচ্ছি।
শেয়ার বিজ: অধিদপ্তরে দৈনিক অভিযোগ দায়ের ও অভিযোগ নিষ্পত্তির হার কেমন?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: অভিযোগের বেশিরভাগই ঢাকার। ঢাকার মানুষরা বেশি সচেতন। গত এক মাসেই প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগ পড়েছে ঢাকায়। মফস্বলের অভিযোগ সংখ্যার দিক থেকে কম। ৯৫ শতাংশ নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় অভিযোগকারীরা ডকুমেন্ট না দেয়ায় সেগুলো নিষ্পত্তি করা যায় না। তবে ই-কমার্সের বিষয়ে আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। প্রায় ১১-১২ হাজার অভিযোগ পেন্ডিং আছে, কারণ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের অফিসও পাওয়া যাচ্ছে না।
শেয়ার বিজ: সাধারণত যেসব বিষয় মিডিয়ার নজরে আসে, সেসব বিষয়েই অধিদপ্তরের তৎপরতা বেশি দেখা যায়। এর বাইরে আর কোন কোন বিষয়ে অধিদপ্তর স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধান করে এবং ব্যবস্থা নেয়?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: আমাদের তো কোনো সোর্স নেই। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কেউ জানালেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে কাচ্চি ভাইকে জরিমানা করা হয়। কসমেটিকস নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়, এটা কিন্তু কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেয়েও যাচ্ছি, নিজেদের মতো করেও যাচ্ছি।
শেয়ার বিজ: রাষ্ট্রীয় সেবা সংস্থাগুলোর সেবার মান নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে গত বছর রেলের টিকিট জালিয়াতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আন্দোলন দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছিল। তারপর অধিদপ্তর সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছিল। সরকারি সংস্থার সেবার বিষয়ে এ ধরনের আর কোনো ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া নজির আছে কি?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: আমরা ১০টি সেবা খাত নিয়ে কাজ করতে পারি। এর মধ্যে পরিবহন খাত ও রেলসেবা পড়ে। রেলের স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়েও আমরা কাজ করব। ওয়াসা ও গ্যাস নিয়েও আমরা কাজ করি। বিমানের টিকিট নিয়ে কাজ করেছি। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করেছি। বাসের টিকিট নিয়ে কাজ করেছি। ১০টি সেবা খাতের মধ্যে শুধু টেলিকম খাত নিয়ে এখন আমরা কাজ করতে পারছি না, কারণ হাইকোর্টে রিট রয়েছে।
শেয়ার বিজ: ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় আগামী দিনে অধিদপ্তর কী ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: ভোক্তার অধিকার সর্বজনীন বিষয়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। উন্নয়নের অনেক জায়গায় আমরা সফলতা দেখিয়েছি; কিন্তু ভোক্তার অধিকার যদি সংরক্ষণ না হয়, তাহলে কিন্তু উন্নয়নগুলো অনেক ক্ষেত্রে ম্লান হয়ে যাবে। প্রত্যেক ভোক্তাকে সচেতন করাই আমাদের প্রথম কাজ।
শেয়ার বিজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: শেয়ার বিজকেও ধন্যবাদ।
উল্লেখ্য, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী, ক্রেতা যেসব বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন, তা হলো বিক্রেতার পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা, সেবার তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করা, পণ্য মজুত করা, ভেজাল পণ্য বিক্রি, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করা, ওজনে ও পরিমাপে কারচুপি, দৈর্ঘ্য পরিমাপের ক্ষেত্রে গজফিতায় কারচুপি, নকল পণ্য প্রস্তুত, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি ও অবহেলা।