ড. হাসান জামিল কম্পিউটার বিজ্ঞানী। যে কজন মানুষের হাত ধরে বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার যাত্রা, তিনি তাদের একজন। ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিকস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগ থেকে স্নাতক এবং ১৯৮৪ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি কানাডার কনকরডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি অর্জন করেন। বতর্মানে অধ্যাপনা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি এসেছিলেন দেশে। শেয়ার বিজ কার্যালয়ে একান্ত আলাপচারিতায় কথা বলেছেন বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নানা দিক ও বাংলাদেশে এর সম্ভাবনার বিষয়ে। এখানে তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার শুরুর দিকটা কেমন ছিল?
ড. হাসান জামিল: আমার লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়া। সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুতও করছিলাম। সময়টা ১৯৭৭ সাল। তখন দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমি এ বিষয়েই পড়াশোনায় বেশি মনোযোগী ছিলাম। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে রিসোর্স সংগ্রহ শুরু করি। এর ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞান জাদুঘরে যোগাযোগ করি। তখন বিজ্ঞান জাদুঘরের পরিচালক ছিলেন ড. সিরাজুল ইসলাম। বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে তার অবদান অনেক। ওই সময় আমি একটি বিজ্ঞান ক্লাব চালু করি। এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করা।
এর ধারাবাহিকতায় আমরা বুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয় চালুর জন্য। কিন্তু তারা রাজি হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। তারা বললো, আমরা সহযোগিতা করতে পারি, তবে আমরা এটা করতে পারবো না। পরে ক্লাব থেকে একটি সেন্টার চালু করলাম। এর নাম দিলাম সেন্টার ফর ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস। সেখানে আমরা কম্পিউটার কোর্স চালু করলাম। এরপর ইউনেস্কোতে চিঠি লিখলাম, বাংলাদেশে
আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রি চালু করতে চাই। কারণ দেশে এটির ভবিষ্যৎ আছে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নও এর ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। পরে ইউনেস্কো থেকে আমাদের পাঁচ হাজার ডলার সহায়তা দেওয়া হলো। তখনকার দিনে পাঁচ হাজার ডলার অনেক টাকা। ওই অর্থ দিয়ে আমরা একটি মাইক্রো কম্পিউটার কিনি। এটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথম মাইক্রো কম্পিউটার। সেটার মাধ্যমে আমরা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শুরু করি। রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থী আসা শুরু করলো। প্রথমে ২০০ টাকা ছিল কোর্স ফি। পরে এটি ৬০০ টাকা পর্যন্ত করা হয়েছিল। ওটাই ছিল মূলত বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার সূচনা। আমাদের ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া অনেকেই এখন ঢাকা শহরে ভালো অবস্থানে আছেন।
শেয়ার বিজ: সম্প্রতি একাডেমিক কাজে চীন সফর করেছেন। প্রযুক্তি খাতে চীনের অগ্রগতি বিষয়ে কিছু বলুন।
ড. হাসান জামিল: অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চীনের সামাজিক সংস্কৃতিতেও ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এটি দেশটির উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে তাদের জন্য এখন যা প্রয়োজন, তা হলো যথাযথ দিকনির্দেশনা। চীনাদের হাতে এখন প্রচুর অর্থ। এটি প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ভালোভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে তারা আরও এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চীনারা প্রযুক্তিতে মৌলিক উদ্ভাবনমূলক কাজে পিছিয়ে আছে। অন্যদের অনুসরণ করার প্রবণতা এখনও রয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় শক্তি। তারা নিজেদের উদ্ভাবন দিয়ে এখনও বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে আধিপত্য দেখিয়ে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে একটা কথা প্রচলিত আছে, আপনি প্রযুক্তি অর্থ দিয়ে কিনতে পারবেন; কিন্তু ব্যবস্থাপনা টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। এটি দীর্ঘ চর্চার মাধ্যমে কোনো জাতির মধ্যে আসে। যুক্তরাষ্ট্র যেটি করতে পেরেছে তা হলো, তারা কিছু বিধিবদ্ধ কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছে। আর তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি গবেষণালব্ধ উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় বিপুল অর্থ খরচ করে। অন্যরা সেটা করছে না। এমনকি চীনের হাতে এখন অঢেল অর্থ আছে; কিন্তু উপযুক্ত নির্দেশনার অভাবে তারাও যথাযথ গবেষণা কার্যক্রম চালাতে পারছে না। ফলে উদ্ভাবনে তারা পিছিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো গবেষকের পেপার প্রকাশ হলে শিল্পোদ্যোক্তারা সেটা দেখেন। সেখান থেকে তারা নতুন কিছু নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হয় না। চীন সম্প্রতি গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো শুরু করেছে। এমনকি তাদের এ খাতে বরাদ্দ এখন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। তবে এ থেকে সুফল পেতে তাদের আরও সময় লাগবে।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে তথ্য–প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি নিয়ে কিছু বলুন। এ খাতে কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, আর এখন আমরা কোন অবস্থানে আছি? আইটি খাতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা কী কী?
ড. হাসান জামিল: এখনও আমাদের দেশে সফটওয়্যারের জন্যে নির্দিষ্ট কোনো নীতি তৈরি হয়নি। সফটওয়্যার তৈরি কিংবা এর গোপনীয়তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা এখনও হয়নি। আপনি মেধাস্বত্ব আইন, প্রাইভেসি আইন—এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানবেনই না; অথচ সফটওয়্যার রফতানি থেকে আয়ের কথা ভাবছেন। এসব বিষয়ের আশু পরিবর্তন ছাড়া প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমেরিকায় একটা আইন আছে, যা ‘অ্যান্টি ট্রাস্ট ল’ নামে পরিচিত। এ আইন সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাদের সুবিধার জন্য। বিষয়টা এমন যে—ধরুন, দুটি কোম্পানি মিলে সিদ্ধান্ত নিলো কোনো একটি পণ্যের দাম তারা ১০০ টাকা ধার্য করবে এবং এ দামে পণ্যটি বাজারজাত করবে। এতে করে যদি একই পণ্য বাজারজাতে অন্য কোম্পানি ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে আইনটি একে নিয়ন্ত্রণ করবে। তার ফলে হয় কি—ভোক্তাদের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর প্রতারণার সুযোগ থাকে না। অথচ এখনও এ বিষয়গুলোতে আমাদের দেশ সচেতন হয়নি। এ সম্পর্কিত কোনো আইন দেশে নেই। ফলে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। কপিরাইট আইন নেই দেশে। এ সুযোগে একজনের তৈরি সফটওয়্যার অন্যজন নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা দেখি না।
ফলে কী কী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা? একটু খোলা চোখে বিষয়টা ভাবলেই উত্তর পাওয়া যাবে। বিদেশের বড় কোম্পানিগুলো আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। বাইরে থেকে যেসব কাজ এখানে আসে, সেগুলো একটা অংশ হিসেবে আসে মাত্র। যেমন—অ্যাপল তাদের কোনো সফটওয়্যার আমাদের এখানে ডেভেলপ করতে দেয় না। যোগ্য ও মেধাবী ডেভেলপার থাকা সত্ত্বেও আমাদের এখানে কেন দিতে চায় না? এর প্রধান কারণ, বিশ্বাসের অভাব। ফলে আমরা বড় কোনো কাজ পাচ্ছি না। ছোট ছোট অল্প কিছু কাজ পাচ্ছি। যেগুলোতে ঝুঁকি কম, পয়সাও কম। আউটসোর্সিং করে আমাদের ছেলেমেয়েরা যে অর্থ বাইরে থেকে আনছে, সেটা বৈশ্বিক সফটওয়্যার বাজারের তুলনায় খুবই নগণ্য। এ অল্প কিছু নিয়ে এত বড় সন্তুষ্টির কোনো কারণ দেখি না। আমাদের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, নকল করার প্রবণতা (প্লেজারিজম)। এ সমস্যা কেবল বাংলাদেশিদের মধ্যে নয়, চীনা ও ভারতীয়দের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। তবে আমাদের এখানে এটা বিরাট আকার ধারণ করেছে।
অন্যের কোনো কাজ নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া কিংবা অনুমতি না নিয়ে কপি করার সংস্কৃতি এখানে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ আমাদের পর্যাপ্ত রিসোর্স আছে। তবে এ খাতে এখনও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হয়নি। এক্ষেত্রে চীনারা এগিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের দক্ষ মানবশক্তি ও মেধাকে মূল্যায়ন করছে এবং তাদের জন্য বিনিয়োগ করছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতও তা-ই করছে, যার ফল আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। প্রযুক্তি খাতে ভারত বর্তমানে দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর একটি।
কিছুদিন আগে দেখলাম, স্কুল-কলেজে বিনামূল্যে ল্যাপটপ দেওয়া হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা ভালো উদ্যোগ; কিন্তু এসব ল্যাপটপ-পিসির ব্যবহার কে শেখাবে, কী কী শেখাবে কিংবা যারা শিক্ষা দেবে, তারা প্রশিক্ষিত কি না—এ নিয়ে কোনো আলোচনা দেখলাম না। তাহলে কাজটা কোথা থেকে হবে? মাঝখান থেকে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা চলে যাবে কোনো ধরনের সিদ্ধিলাভ ছাড়াই।
কিছুদিন আগে একজন বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে কাজে লাগানোর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আমি বললাম, সুযোগ-সুবিধা আর কাজ পেলে কেন নয়? তিনি জানালেন, একটা বিজনেস ডেভেলপ করতে চান, যেটা কি না ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। আমি তাকে জানালাম, এটা এখন প্রায় অসম্ভব। কেননা ফেসবুক একটা প্রতিষ্ঠিত বিলিয়ন ডলার কোম্পানি। ওদের টেক্কা দেওয়া সহজ নয়; বরং প্রায় অসম্ভব। আমি অবাক হলাম ভেবে যে, উনি এমন একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে চান অথচ সে বিষয়ে তার কোনো জ্ঞানই নেই। এ ধরনের উদাহরণ আমাদের প্রায় প্রতিটি খাত নিয়েই দেওয়া সম্ভব। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত ও কোটি টাকার মালিকের যদি আইটি জ্ঞান এত স্বল্প থাকে, তাহলে কীভাবে বাকিদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করবো?
শেয়ার বিজ: আপনার কি মনে হয়, দেশে মেধাবী আইটি স্কলার আছে? আইটি খাতের স্টুডেন্টদের অবস্থা কী?
ড. হাসান জামিল: আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থা ভালো। বিশেষ করে, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, তারা বেশ মেধাবী। কিন্তু আমরা তাদের মেধাটাকে নষ্ট করে দিই। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা বড় সময় শিক্ষার্থীরা টিউশনি করেই কাটিয়ে দেয়। যার ফলে তাদের দৈনন্দিন আচরণ ও অভ্যাসে পরিবর্তন আসে। তাদের মেধা তারা কাজে লাগানোর পরিবর্তে নষ্ট করে ফেলছে। কীভাবে ফাঁকি দিতে হয়, কীভাবে ক্লাস না করেও পরীক্ষায় বেশি মার্ক পাওয়া যায়, কতটা সহজ উপায়ে পাস করা যায় ইত্যাদি রপ্ত করতে গিয়ে নিজেদের মৌলিক মেধাটাকে আর কাজে লাগায় না। অথচ তারা প্রত্যেকে মেধাবী। এভাবেই তারা বিলীন হতে থাকে। সবকিছুতে শর্টকাট খোঁজে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের অবস্থা বেশ ভালো। আইটি ডেভেলপমেন্টের দিক থেকে এরা বেশ এগিয়ে। বিষয়টা এ জন্য হয়েছে যে, সেখানে কালচারটা এভাবেই গড়ে উঠছে। ওদেরও একটা শ্রেণি টিউশনিতে নিজের মেধাটা ঢেলে দিচ্ছে, আর গুটিকজন একাডেমিক কাজে নিজের পুরোটা দিচ্ছে। ফল আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আমরা দিন দিন এমন একটা জাতিতে পরিণত হচ্ছি, যাদের আইটি ও গবেষণা নিয়ে কোনো দূরদর্শী চিন্তা নেই। নেই কোনো ‘ন্যাশনাল ভিশন’। বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। সর্বোপরি মেধাস্বত্ব ধরে রাখার কোনো প্রক্রিয়া নেই।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে কম্পিউটার বিজ্ঞান যখন যাত্রা করে, তখন এটি নিয়ে সবার মধ্যে অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই আমরা দেখেছি, সেই ক্রেজটা হারিয়ে গেলো। কারণ কী?
ড. হাসান জামিল: কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশে একসময় যে ক্রেজ ছিল, সেটা অন্য দেশে এখনও আছে। কিন্তু দেশে এখনও আমরা সেই বাজার তৈরি করতে পারিনি। আমরা আইটি স্কলার তৈরি করেছি; কিন্তু তাদের যথাযথ কাজের ক্ষেত্রে পৌঁছে দিতে পারিনি। ফলে আকাশসমান স্বপ্ন নিয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়া ছেলেটি প্রাপ্তির খাতায় এসে পেয়েছে কিয়দংশ মাত্র। এতে কম্পিউটার বিজ্ঞানে যারা ভালো করেন, তারা আর দেশে থাকছেন না। একটা উদাহরণ দিই। একবার আমেরিকায় এক প্রতিবেদনে দেখা গেলো, পুরো দেশে ২০ লাখ নার্স দরকার। তখন সোসাইটি কালচার বাংলাদেশ নামে একটা গ্রুপ ছিল। এ তথ্য পেয়ে তারা বেশ খুশি। তারা ভাবলো, বাংলাদেশে নার্সিং ইনস্টিটিউট খুলে আমেরিকায় নার্স পাঠাবে। কাজটা তারা শুরু করলো ঠিকই; কিন্তু এ প্রজেক্ট সফলতার মুখ দেখলো না। কারণ আমেরিকায় নার্স পাঠাতে একজন লাইসেন্সধারী ও যোগ্য নার্স হওয়া দরকার। আপনি যেনতেন একটা ইনস্টিটিউট খুলে তো আর নার্স বানালে হবে না। আমাদের আইটি খাতের অবস্থাও মোটামুটি একই রকম। একটা সময় হৈ-হুল্লোড় করে কম্পিউটার বিজ্ঞানকে বাংলাদেশে আনা হলো; কিন্তু এ বিষয়ে লেখাপড়া করাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানি গড়ে উঠলো না। ফলটা কী হলো? ভালো ছাত্ররা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে সুযোগ নিয়ে। আর যারা মধ্যম পর্যায়ের জ্ঞানসম্পন্ন, তারা কী করবে? তাদের তো এখানেই সুযোগ দেওয়া উচিত। তা না হলে এই মেধা ধীরে ধীরে নষ্ট হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। তবে আশার কথা, আমাদের দেশে কম্পিউটার বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের স্কলাররা কাজ করছে। এখন সময় এসেছে দেশের অভ্যন্তরীণ আইটি বাজার উন্নয়ন করার; আইটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার।
কিছুদিন আগের কথা। আমি আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এলাম। এয়ারপোর্টে আমাদের আধা ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। সমস্যা জানতে চাইলে বললো, সফটওয়্যার হ্যাং করেছে। আমার প্রশ্ন হলো, সফটওয়্যার কীভাবে হ্যাং করে? একটা অপারেশনের মাঝখানে সফটওয়্যার হ্যাং করবে কেন? সমস্যাটা হচ্ছে, সফটওয়্যারটি এমন একজন তৈরি করেছেন, যার এ-সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞান ছিল না। যারা এর মান নিশ্চিত করেছেন, তারাও ভালোভাবে দেখে নিতে পারেননি। কোটি কোটি টাকা দিয়ে কেনা সফটওয়্যার হ্যাং করলো, কারণ আমাদের আইটি ইন্ডাস্ট্রি উন্নত নয়। সফটওয়্যারটিতে কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি না, সেটি নিশ্চিত করার মতোও কেউ গড়ে ওঠেনি।
সবকিছুর পরও আশার কথা এখানে প্রচুর ট্যালেন্ট আছে। আমাদের সবারই উচিত হবে এর যথাযথ ব্যবহার করা। সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকদের একটু বেশি যত্নবান হতে হবে। কারণ তাদের ওপর পুরো ভবিষ্যৎ ও জাতিগঠনের বিষয়টা নির্ভর করে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যারা আছে, তাদেরও উচিত হবে সময়কে হেলাফেলা না করে যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার করা। আমার বিশ্বাস, দ্রুতই আমাদের জন্য সুদিন আসবে।
শেয়ার বিজ: লার্জ স্কেল ডেটা ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আপনি গবেষণা করেন। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. হাসান জামিল: কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতোই আরেকটা বিষয় হচ্ছে ডেটা সায়েন্স। এটা এমন এক বিষয়, যেখানে আপনার কাছে উপাত্ত আছে, এখন আপনি এ উপাত্ত থেকে একটা তত্ত্ব দাঁড় করাবেন। আমেরিকায় প্রত্যেকটা রাস্তায় হাজার হাজার ক্যামেরা লাগানো আছে, যেগুলো প্রতিমুহূর্তে ভিডিও পাঠাচ্ছে। সেখানে তাদের সব ডেটা সংগ্রহের জন্য ডেটা সেন্টার আছে। ডেটা সেন্টারকে প্রতিদিন বিলিয়ন পেটাবাইটের ডেটা সংগ্রহ করতে হয়। প্রক্রিয়াকরণ করতে হয় সেগুলো। যেমন ধরুন স্যাটেলাইট সফটওয়্যার। পৃথিবীর নিত্যকার ঘটনা তারা ইমেজ প্রসেসিং করে পাঠাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। এ ধরনের টেকনোলজিক্যাল ডেটা, ম্যাথমেটিক্যাল ডেটা, সোশ্যাল ডেটাসহ অন্যান্য ডেটা নিয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত আগে থেকে অনুমান করাই হলো লার্জ স্কেল ডেটা ম্যানেজমেন্ট।