পুরান ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্য ঘোড়ায় টানা টমটম গাড়ি। ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের প্রায় ২০০ বছরজুড়ে রয়েছে এই ঘোড়ার গাড়ির ঐতিহ্য। ঢাকায় এই গাড়ির প্রচলন করেন ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আর্মেনিয়ার এক ব্যবসায়ী। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা থেকে ঘোড়ার গাড়ির আমদানি শুরু হয়। তখন ‘ঠিকা গাড়ি’ নামেও পরিচিত ছিল এটি। ঢাকায় যেসব ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায়, সেগুলোর নাম ‘ক্রাহাঞ্চি’ বা ‘ক্রাঞ্চি’ গাড়ি। এগুলোকে ‘কারাচি গাড়ি’ও বলা হতো। বর্তমানে স্থানীয়দের কাছে এটি টমটম নামেই অধিক পরিচিত। সময়ের ব্যবধানে বাংলার ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাহনটি। মাটির রাস্তায় প্রথম যানবাহনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির যাত্রা শুরু হলেও ঘোড়ার গাড়ি ঢাকা শহরে চলাচলের সুবিধার্থে রাস্তাঘাটের সংস্কার করা হয়। প্রথমে ইট-সুরকি, সিমেন্ট-বালি এবং পরে পিচঢালা ইট দিয়ে রাস্তা সংস্কারের কাজ করা হয়েছিল। সর্বপ্রথম ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার ইংরেজরা শুরু করলেও স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির মানুষও এই সুবিধা নেয়। একসময় তা সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। সাধারণত কোনো উৎসব আয়োজনে বিনোদন কিংবা শখ মেটাতে বেশি ব্যবহƒত হয় টমটম। বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা কিংবা চলচ্চিত্রের শুটিংয়েও ব্যবহƒত হয় যানটি। পুরান ঢাকার বিয়েতে তো ঘোড়ার গাড়ি না হলেই নয়।
চলাচলে একটু আনন্দ ও সুবিধা পেতেই মূলত অনেকে এখনও চড়ে থাকেন ঘোড়ার গাড়িতে। তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে বঙ্গবাজার, লক্ষ্মীবাজার, আজিমপুর, বকশীবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিকবাজার ও কেরানীগঞ্জে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করছে। একটি ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করতে মালিকের প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানা যায়। গাড়ির আকার ও ঘোড়ার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে যাত্রী কতজন ওঠানো যাবে। আগে ঘোড়ার গাড়ি নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও আধুনিকতার ভিড়ে ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে কমে গেছে এর যাত্রীও। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই ঘোড়ার গাড়ি। একেকটি গাড়ি প্রতিদিন সর্বোচ্চ ছয়বার সদরঘাট-গুলিস্তান রুটে যাওয়া-আসা করতে পারে। যাত্রীপ্রতি ভাড়া ৩০-৪০ টাকা হলেও বিশেষ দিনগুলোয় তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রতিটি টমটমে একজন করে কোচয়ান-হেলপার থাকে। কোচয়ানরা ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। হেল্পাররা মালামালসহ যাত্রীদের গাড়িতে উঠতে সহায়তা করে। এসব গাড়ি থেকে মালিকপক্ষ প্রচুর আয় করলেও ঘোড়ার সঠিক পরিচর্যা হচ্ছে না। ভুসি, ঘাসসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ায় খরচ অনেক বেড়েছে। এখন আর ঘোড়াকে তিনবেলা খাবার দেয়া সম্ভব হয় না। প্রায় ঘোড়া অসুস্থ হয়ে যায়।
গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যেতে ঘোড়ায় টানা বাহারি আকৃতি ও রঙের চার চাকাবিশিষ্ট টমটম গাড়ি চোখে পড়ে। ব্যবসার হিসাবে প্রতিদিন একটি টমটম থেকে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। একজন মালিকের একাধিক টমটম থাকে। কোচোয়ান সাধারণত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে। ঘোড়ার গাড়ির খরচ বলতে ঘোড়ার খাবার (খড়, ভুসি) এবং ঘোড়ার পায়ে পরানো স্টেইনলেস স্টিলের নাল (ঐড়ব) কিনতে যে খরচ হয়, তা বোঝায়। মূলত এ ব্যবসায় ঘোড়ার গাড়ির মালিকের লাভের অংশই বেশি।
সাধারণ মানুষ থেকে অভিজাত মানুষের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই টমটম গাড়ির পেছনে যুগ যুগ ধরে যে অমানবিক নিষ্ঠুরতা বয়ে চলেছে, বাংলার ঐতিহ্যে তা কারও দৃষ্টিতে অমানবিক বলে মনে হয় না। সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উল্টো পিঠে দিন দিন যে নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়েই চলেছে, তা যেন স্বাভাবিক। কারণ সাধারণ মানুষের চোখ শুধু বাইরের আবরণটাই দেখে। টমটম গাড়ির ঘোড়া যখন গড়ে চার-পাঁচশ কেজি ওজনের যাত্রী নিয়ে পিচঢালা পথে দৌড়ায়, তখন তার পায়ের শক্ত খুর ক্ষয়ে পায়ের নরম মাংস বের হয়ে যায়। এই নরম মাংসের ওপর ভর করে পিচঢালা পথে দৌড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ঘোড়ার পায়ের খুরের নিচে স্টেইনলেস স্টিলের খাঁজ পরানো হয়, যাতে পায়ের খুর ক্ষয় না হয়। নিষ্ঠুরতা হলো পায়ের মাংসে পেরেক দিয়ে যখন স্টিলের খাঁজ লাগানো হয়, সে পেরেক নরম মাংসেই গিয়ে লাগে। ফলে অসম্ভব যন্ত্রণা এবং ব্যথা নিয়ে ঘোড়াকে পিচের ওপর দৌড়াতে হয়। সাধারণত একটি স্টিলের খাঁজ এক দিনের বেশি টেকসই হয় না। প্রতিদিন দুই পায়ে দুটি নাল পরালে একটি ঘোড়া সুস্থভাবে দুই ঘণ্টা দৌড়াতে পারে। কিন্তু এক কেজি স্টিলের নাল কিনতে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লাগে। এক কেজিতে আট থেকে ১০টি নাল পাওয়া যায়। এই খরচের টাকা টমটম মালিকের কাছে বাহুল্য মনে হয় বলে প্রতিদিন ঘোড়ার নাল পরিবর্তন করা হয় না। অসহায় একটি প্রাণী যখন ব্যথায় কাতরায় কিংবা যন্ত্রণাক্লিষ্ট পা শক্ত পিচে ফেলে দৌড়াতে পারে না, তখন কোচোয়ানের চাবুক শপাং-শপাং ঘোড়ার পিঠে পড়তে থাকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় এই অমানবিক নিষ্ঠুরতা আমরা উপভোগ করছি প্রতিদিন। রিকশা, বাস, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার থাকতে এখনও এই অমানবিক ঘোড়ায় টানা গাড়ি নগরের সড়কে মানুষের যানবাহন হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। শুধু ঘোড়া একটি অসহায় প্রাণী বলে আমরা দিনের পর দিন এমন নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারছি। জগতের সব অন্যায় ও অত্যাচার দুর্বলরাই ভোগ করবে, এমনটাই পদে পদে প্রকাশ করছে আধুনিক যুগে শহুরে সভ্য মানুষ।
পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক নিষ্ঠুরতা আমরা দেখেছি। যুগে যুগে সেসব নিষ্ঠুরতার অবসান হয়েছে, মানুষ সভ্য হচ্ছে। কিন্তু সভ্যতার আড়ালেও ভদ্রবেশে চলছে এই দুর্বল প্রাণীর প্রতি অমানবিক অত্যাচার। রাজধানীতে প্রাণীর প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা মেনে নেয়া প্রকৃতপক্ষে অমানবিকতাকে প্রশ্রয় দেয়া। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অমানবিকতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা।
মাকসুদা আক্তার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়