ওসমান এহতেসাম: গত ২ আগস্ট রাতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচির ভিডিও দেখছিলাম। চ্যানেল ঘোরাতে গিয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশো ‘টু দ্য পয়েন্ট’ শীর্ষক টকশো সামনে এলো। অনুষ্ঠানটি দেখার পর বাবাকে বললাম, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারক থাকাকালীন হয়তো অনেক বিতর্কিত রায় দিয়েছেন। না জানি, তার ভুল রায়ে কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সত্যি বলতে, আমি তার নাম আগে কখনও শুনিনি। কাজেই চেনারও কথা নয়। টকশোটি দেখার মাধ্যমেই তাকে চিনলাম। তাকে না চিনেই, একদিনের টকশো দেখেই আমার মনে হলো ন্যায় বিচার করার মতো গুণ তার নেই। একজন বিচারপতি হিসেবে মামলার তথ্য ও প্রমাণগুলো বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যে ধরনের বিশ্লেষণ চিন্তাশক্তি প্রয়োজন, তা তার মধ্যে নেই। কিন্তু আমার এ ধারণা কতটুকু যৌক্তিক! নাকি না জেনেই কারও বিরুদ্ধে অন্যায্য সমালোচনা করলাম! কিন্তু গুগলে সার্চ দিয়ে এর সত্যতা পেয়েছি। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত রায় দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন। তার কারণে বিচার অঙ্গনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে নানা সময়ে একমত পোষণ করেছেন সরকার ও বিরোধীপক্ষের আইনজীবীরা।
‘টু দ্য পয়েন্ট’ নামের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে সঞ্চালক দীপ্তি চৌধুরীর সঙ্গে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দুর্ব্যবহার সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালেচিত হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আলোচনা চলাকালীন, বিচারপতি মানিকের উত্তেজিত আচরণ এবং দীপ্তির পেশাদারি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এ ঘটনাটি কেবল একটি টকশো নয়, বরং এর মাধ্যমে একটি বৃহত্তর সামাজিক ও পেশাগত মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছে। অনেকে হয়তো দেখেছেন, ৪৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের অনুষ্ঠান চলারা শুরুতেই মেজাজ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি আন্দোলনকারী সব শিক্ষার্থীকে রাজাকারের বাচ্চা সম্বোধন করে আলোচনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ও তিনি এ শব্দটি বহুবার উচ্চারণ করেছেন, বাধা সৃষ্টি করেছেন সঞ্চালকের উপস্থাপনায়। সঞ্চালক বারবার কেন তাকে প্রশ্ন করছেনÑএমনটা তিনি মানতে পারছিলেন না। তার পরও দীপ্তি চৌধুরী তাকে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মেজাজ হারানো মানিক তার প্রশ্নের একটি উত্তরও দিতে পারেননি বা দেননি। বরং দেশের ৪ কোটি রাজাকারের মুখস্থ রচনা বর্ণনা করে ‘এবার আপনার প্রশ্নে আসি’ বলে পুনরায় রাজাকারের রচনায় ফিরে গেছে। একজন বিচারপতির বক্তব্যে যে বিশ্লেষণ আমরা শুনতে চেয়েছি, তার যেন কিছুই পাইনি। সঞ্চালকও যেন বিপদ বুঝতে পেরে ফিরে গেলেন অনুষ্ঠানের সহআলোচক প্রাবন্ধিক পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনির কাছে। টকশোতে বড় গুণ সর্বজনবিদিতÑতিনি টকশোতে কখনোই উত্তেজিত হন না। প্রতিপক্ষ যতই উত্তেজিত হোন না কেন, তিনি নীরবই থাকেন। স্মিত হাসিতে প্রতিপক্ষকে যুক্তিতে ঘায়েল করাই তার বৈশিষ্ট্য। তার বক্তব্যের কাছে হেরেছেন অনেক শক্তিশালী নেতা। বলা বাহুল্য, ওই দিনও অন্যান্য দিনের মতো বাগ্যুদ্ধে যথারীতি পরাজিত হয়েছেন বিচারপতি মানিক। গোলাম মাওলা রনি তার উদ্দেশ্যে বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যাটি হলো রাজনৈতিক সমস্যা। যেহেতু তিনি (বিচারপতি মানিক) বিচার বিভাগের মানুষ, বিচার-আচার, আইন-কানুনের বাইরে তার ব্রেন রাজনৈতিকভাবে অন্য সবার মতো কাজ করবে না। তাই আমি তার সঙ্গে বিতর্কে জড়াব না। এ কথার মাধ্যমে গোলাম মাওলা রনি যে বিচারপতির বুকে কথার সুই ঢুকিয়ে দিলেন, তা যেন টেরই পেলেন না তিনি। এটিই টকশোর সৌন্দর্য। বক্তার এ বক্তব্য পুরো অনুষ্ঠানকে সার্থক করেছে।
গোলাম মাওলা রনি তার রাজাকার রচনা নিয়েও হাস্যরস করেছেন। বিচারপতি আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে রাজাকার আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বললে, গোলাম মাওলা রনি বলেন, উনার কথামতো যদি ৪ কোটি রাজাকারের বাচ্চা এই বাংলাদেশে থাকে, তার সঙ্গে যদি চার কোটি রাজাকারের বাপ-মা, নাতি-পুতি ও প্রেমিক-প্রেমিকা থাকে তাহলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি। একজন রাজাকারের ছেলে-মেয়ে কখনোই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সঙ্গে প্রেম করবে না। রাজাকার রাজাকারদের বিয়ে করবে। আর ১২ কোটি এই রাজাকারদের কখনোই পাকিস্তানের পাঠানো সম্ভব হবে না। বরং ১২ কোটি রাজাকার যদি এক হয়ে যায় তারা অনেককে ভারতে পাঠিয়ে দিতে পারে। গোলাম মাওলা রনি যখন এ কথা বলছিলেন, তখন তার দিকে আহত বাঘের মতো তাকানো ছাড়া উপায় ছিল না বিচারপতি মানিকের। বিচারপতি মানিক যে যৌক্তিক যুক্তি খণ্ডন করতে পারেন না, তা ওই টকশোতেই প্রমাণিত হয়েছে।
‘পুলিশ প্রয়োজনে গুলি করেছে’Ñবিচারপতি মানিকের এমন বক্তব্যে উপস্থাপক জানতে চান, আপনি কি আবু সাঈদের মৃত্যুর ভিডিও দেখেছেন? তখনই মেজাজ হারিয়ে চেঁচামেচি শুরু করেন মানিক। যৌক্তিক ব্যাখ্যা না দিয়ে তার দাবি, আবু সাঈদের হাতে অস্ত্র ছিল, তাই পুলিশ তাকে গুলি করেছে। অথচ ভিডিওতে দেখা গেছে, আবু সাঈদ ছিল নিরস্ত্র। হাতে ছিল একটি লাঠি। এটিকে প্রাণঘাতী অস্ত্র কোনো পাগলও বলবে না। তাছাড়া আবু সাঈদ কারোর ওপর হামলা করেননি যে; তাকে গুলি করতে হবে। তারপরও আবু সাঈদকে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পুলিশ কর্তৃক হত্যার কথাটি স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জানলেও এ যেন চোখেই দেখেননি বিচারপতি মানিক। অথচ তা না বলেও অনুষ্ঠানের উপস্থাপককে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। শুধু অনুষ্ঠান চলাকালেই যে বিতর্কিত আচরণ করেছেন এমনটা নয়, অনুষ্ঠান শেষে দীপ্তি চৌধুরীকে রাজাকারের বাচ্চাও বলেছেন তিনি। এমন আচরণ কখনোই একজন গুণী বিচারপতি তথা নিরপেক্ষ ব্যক্তির আচরণ হতে পারে না। বাঙালি জাতি এমন জ্ঞানহীন একজন বিচারকের কাছে কিছু আশাও করে না। সন্দেহের বিষয় হলো, আদৌ কি বিচারপতি হিসেবে তিনি ন্যায়বিচার করতে পেরেছেন। কথায় কথায় উত্তেজিত হওয়া মানুষ কি আদৌ বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, নাকি বিচারকরা এমনই হন! জানতে ইচ্ছে করে, তার বিচারাধীন আদালতে, তার উত্তেজিত মেজাজের সামনে, আইনজীবীরা কি আদৌ স্বাধীনভাবে শুনানি করতে পেরেছিলেন?
একজন বিচারপতির বড় গুণ হলো বিশ্লেষণী ক্ষমতা। কিন্তু তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও আচরণ এতই নিম্ন যে, তা বরাবরই জাতির কাছে অপ্রত্যাশিত। একজন বিচারপতির কাছ থেকে আরও অনেক বেশি সুশৃঙ্খল ও যুক্তিসঙ্গত আচরণ আশা করা হয়। যিনি নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম, তার কাছ থেকে নিরপেক্ষ ও সঠিক বিচার পাওয়া কতটা সম্ভব; তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিচারপতি মানিকের উত্তেজিত হয়ে দীপ্তি চৌধুরীকে রাজাকারের বাচ্চা বলা বিচারবহির্ভূত ও অপেশাদার আচরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এটি শুধু ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং বিচারপতির রায়দান ক্ষমতা ও নৈতিকতার ওপরও প্রশ্ন তুলেছে।
অন্যদিকে দীপ্তি চৌধুরী একজন পেশাদার খ্যাতিমান উপস্থাপিকা। তার প্রতিটি উপস্থাপনা আমাদের বরাবরের মতোই মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করেছে বহুল আলোচিত ওই দিনের ওই টকশোর উপস্থাপনাও। একজন সঞ্চালকের প্রধান দায়িত্ব হলো তার অতিথিদের সম্মান দেখানো ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা। উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরী এই দায়িত্ব পালনে কোনো কমতি রাখেননি। বিচারপতির অসৌজন্যমূলক কথার প্রতিক্রিয়ায় তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে যাননি এবং পেশাদারি বজায় রেখেছেন। তার এই ধৈর্য ও বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা তাকে সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা এনে দিয়েছে।
প্রায় ৪৯ মিনিটের এই শোতে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা, উপস্থাপনা, ধৈর্য ও বাচনভঙ্গির কারণে প্রশংসায় ভেসেছেন দীপ্তি। সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ছোট ছোট ক্লিপ। সেখানে নেটিজেনরা দীপ্তির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু পক্ষপাতের বিচারপতি মানিক উল্টো ওই খ্যাতিমান উপস্থাপককে অন্য একটি পক্ষের বলেও অভিহিত করেছেন। এক কথায় বলা যায়, ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শোটাইম পার করেন সঞ্চালক। এদিকে দেশের মানুষ দেখেছেন, আলোচনার শুরুতেই শিক্ষার্থীদের রাজাকার সম্বোধন করে ভিন্ন প্রান্তে অবস্থান নিয়েছেন বিচারপতি মানিক। ভিন্ন প্রান্তের সেই বিচারপতি কীভাবে নিরপেক্ষ হয়, কীভাবেই বা দু’পক্ষের অভিভাবক হয়ে সমাধানের পথ খুঁজবেন! তারা নিজে নিরপেক্ষ না হওয়ায়, অন্যের নিরপেক্ষতা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। উপস্থাপক যদি একটি পক্ষের দালালি করে তার সুরে কথা বলতেনÑতাহলে হয়তো তিনি বলতেনÑ ভেরি গুড। অন্যভাবে উপস্থাপন করলে বলা যায়, অযোগ্য ব্যক্তিকে টকশোতে আনলে যা হওয়ার কথা, তাই হয়েছে।
এ ঘটনা আমাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখায় পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতার মানদণ্ড। টেলিভিশন চ্যানেলগুালোর উচিত টকশোর অতিথি নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা। যোগ্য ও প্রফেশনাল ব্যক্তিত্বদের টকশোতে আমন্ত্রণ জানিয়ে, তারা টকশোর মান বৃদ্ধি করতে পারে এবং দর্শকদের জন্য উপকারী আলোচনা প্রদান করতে পারে। অযোগ্য ব্যক্তিদের টকশোতে আনার ফলে যা হতে পারে, তা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ আরও সচেতন হতে পারি।