অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়িক নীতি ও মূল্যবোধের গুরুত্ব

মাহমুদুল হাসান: ব্যবসায়িক মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতা যথাযথভাবে মেনে চলা কল্যাণমূলক অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারণ ব্যবসায়িক নীতি ছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন অসম্ভব। এই নীতি ও নৈতিকতা ব্যবসায়ীকে সৎ ও নীতিবান হওয়ার  পাশাপাশি মুনাফা অর্জন ছাড়াও ভোক্তা ও গ্রাহকের প্রতি সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে শেখায়। ব্যবসায়িক মূল্যবোধ এমন একটি মানদণ্ডকে বোঝায়, যার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়িক রীতিনীতি ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এককথায় ব্যবসায় কী কী করণীয় এবং কী কী বর্জনীয়, তার সামষ্টিক জ্ঞানই হলো ব্যবসায়িক নীতি। ব্যবসা একটি আয়ের স্বতঃসিদ্ধ বৈধ উৎস। কিন্তু নীতিবহির্ভূত ব্যবসার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ভেজাল পণ্য বিক্রি, কর ফাঁকি, নিষিদ্ধ পণ্যের বাজারজাতকরণ ও সরবরাহ, অন্যায্য মজুরি, অহেতুক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, যত্রতত্র শিল্পায়নের নামে পরিবেশের ক্ষতিসাধন,  ওজনে কম দেয়াসহ নানা ব্যবসায়িক অপকর্ম ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নীতিবহির্ভূত গর্হিত কাজ, যা একটি দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। মদ, ইয়াবা, পর্নো ইন্ডাস্ট্রি, হুন্ডি ব্যবসা, চোরাকারবারসহ রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ নানা সেক্টরে বিনিয়োগে ব্যক্তিগত মুনাফা হাসিল হলেও এটা জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। তাই ব্যবসায়িক নীতি ও মূল্যবোধ কখনও অবৈধ সেক্টরে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয় না। এই নীতি ও মূল্যবোধের অভাবে রাষ্ট্র তার রাজস্ব, ভোক্তা তার ন্যায্য সেবা এবং সমাজ তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ অসাধু ব্যবসীয়ারা সর্বদা ওত পেতে থাকেÑকখন কীভাবে কর ফাঁকি দেয়া যায়, কীভাবে ভেজাল পণ্য বিক্রি করা যায়, কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করা যায়।

ব্যবসা একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। শুধু মুনাফা অর্জন ব্যবসার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। বরং মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ তথা ভোক্তা, ক্রেতা, শ্রমিক, কর্মচারী, রাষ্ট্র, সমাজসহ সবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন ও সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একান্ত কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা। এটি পালন করা ব্যবসায়িক নীতি ও মূল্যবোধের অপরিহার্য শর্ত।  ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা একটি দেশের অর্থনীতিতে ন্যায্য ও সমতা নিশ্চিত করে, সমবণ্টনভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, শ্রেণিবৈষম্য দূর করে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করে।

কিন্তু আজ সারাবিশ্বে ব্যবসায়িক নীতি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাবে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। এক রাষ্ট্র অন্য ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পণ্য বয়কট, বাণিজ্যিক চুক্তিতে ধনী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষপাতিত্ব, গরিব রাষ্ট্রের ওপর চড়া সুদে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়াসহ অহেতুক অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা, যা ব্যবসায়িক নীতি মেনে না চলার কুফল।

গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়, বেতনভাতা নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে পুলিশ শ্রমিক ত্রিমুখী সংঘর্ষ, ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন, রাস্তাঘাট অবরোধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ-সমাবেশ, অধিক মুনাফার আশায় অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক কৃত্রিম সংকট তৈরি করার উদ্দেশ্যে পণ্যের মজুত ও গুদামজাতকরণ, কালোবাজারি, করফাঁকি দেয়া প্রভৃতি নিত্যদিনের ঘটনা এই কথাই জানান দিচ্ছে যে, দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসায়িক মূল্যবোধ বলতে কিছু নেই।

পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই বুদ্ধি ও বিচারবোধসম্পন্ন প্রাণী। ভালো-খারাপ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার বোধশক্তি আছে বলেই মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু মানুষ নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্যের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত। নীতি-নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের কথা ভুলে গিয়ে অন্যকে কীভাবে ঠকানো যায়, তার ফন্দি আঁটতে ব্যস্ত। ফলে দেশে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজমান।

সামাজিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে ব্যবসায়িক নীতি, মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতার কোনো বিকল্প নেই। শ্রমিক ও কর্মচারীর প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব দায়বদ্ধতা যেমনÑক. উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও আর্থিক সুবিধা প্রদান; খ. চাকরির নিরাপত্তার বিধান; গ. কাজের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি; ঘ. প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির ব্যবস্থা; ঙ. বাসস্থান ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা ব্যবসায়িক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।

অন্যদিকে সরকারকে নিয়মিত কর ও রাজস্ব প্রদান, সরকারের আর্থিক ও রাজস্ব নীতিসহ সব রীতিনীতি মেনে চলা, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা, বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচার না করাÑএসব রাষ্ট্রের প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা।

ক্রেতা ও ভোক্তার প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দায়বদ্ধতা ও ব্যবসায়িক নীতিগুলো হচ্ছেÑ১. পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা; ২.পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা; ৩. মানসম্মত পণ্য সরবারাহ করা; ৪ ওজনে কম না দেয়া; ৫. পণ্যসামগ্রীর প্রাপ্তি সহজতর করা; ৬. পণ্য ও বাজার-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করা। 

সমাজের প্রতিও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা কখনও এড়িয়ে যাওয়ার নয়। সেগুলো হচ্ছে সমাজের প্রয়োজন অনুসারে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করা, বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, পরিবেশ দূষণ থেকে এলাকা রক্ষা করা, পণ্যের মজুতদারি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করা, জাতীয় দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়ানো।

ভোক্তা, রাষ্ট্র ও সমাজের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা ও দূষণরোধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা ও ব্যবসায়িক অনেক নীতি রয়েছে, যা পালন করা একান্ত কর্তব্য।

পরিবেশ দূষণ শিল্পায়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা। শিল্পবর্জ্য থেকে নির্গত তরল পদার্থ একদিকে যেভাবে পানি দূষিত করছে, অন্যদিকে কলকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণ করছে। ফলে মাছসহ জলজ প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। মৎস্যসম্পদের প্রধান উৎস নদীনালা ও খালবিলে কলকারখানার রাসায়নিক বিষাক্ত  তরল পদার্থ পতিত হওয়ায় মাছের জন্য নদী ও খালবিল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

অনুরূপভাবে কলকারখানার কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণ করছে। ফলে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের মতো নানা রোগবালাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। কলকারখানার মেশিন ও জেনারেটরের বিকট শব্দে প্রতিবছর অনেক শিশু শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রপক্ষ এসব ক্ষতির দায় কখনও এড়িয়ে যেতে পারে না। পরিবেশ রক্ষা ও দূষণরোধে ব্যবসায়িক দায়বদ্ধতা ও রীতিনীতি  যথাযথভাবে পালন করা আবশ্যক। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতিকরণ, প্রতিটি কলকারখানার নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার নিশ্চিতকরণ, উন্নত পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রাষ্ট্রপক্ষ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে দেশের মৎস্য ও বনজ সম্পদ সুরক্ষিত থাকে। এটা পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দায়বদ্ধতা।

যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সব সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কুক্ষিগত, সেখানে ব্যবসায়িক নীতি বলতে কিছু নেই। ফলে ধনীরা আরও ধনী, গরিবরা আরও গরিব হয়। দেশে অর্থনেতিক মূল্যবোধের অভাবের কারণেই গরিবরা সবসময় শোষিত ও নিষ্পেষিত হয়। একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থায় মুনাফা সর্বোচ্চকরণ ছাড়া সাম্য ও ন্যায্য বলতে কিছু থাকে। অর্থনৈতিক নীতি না থাকায় ফার্ম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বাইরে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে। অর্থনীতির এই যুগে চা শ্রমিকদের বেতন ১২০ টাকা, এটা কি কখনও ভাবা যায়? হ্যাঁ, এটা মূল্যবোধহীন রক্তচোষা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্ভব। আমরা চা নয়, যেন শ্রমিকদের রক্ত খাচ্ছি। বাবুরা বাবুগিরিতে লিপ্ত আর গরিবরা খেটে মরে। এটা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা। এটা চা মালিকদের অর্থনৈতিক মূল্যবোধ ও অনৈতিকতার পরিচয়।

অর্থনৈতিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাবে একটি রাষ্ট্র দুর্নীতির শিকার হয়। ব্যবসায়িক নীতি ও শিষ্টাচার ব্যতিরেকে কোনো রাষ্ট্র কল্যাণমূলক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশ ও দশের স্বার্থে সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক নীতি ও শিষ্টাচার মেনে চলা একান্ত কর্তব্য।

শিক্ষার্থী

অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়